ফেব্রুয়ারী ২৭, ২০২২:
প্রবাস বন্ধু পাঠচক্র-এর প্রথম, “এই জানা আমার ফুরাবে না”, পর্বটি পঞ্চাশের দশকের স্বনামধন্য কবি অধ্যাপক শ্রী শঙ্খ ঘোষকে নিয়ে শুরু হল। অসিতদার আগ্রহে ও অনুরোধে এই পর্বের সূচনা। এই মাস কবির জন্ম মাস, তাই তাঁকে নিয়ে আমাদের বিনম্র প্রণাম।
শ্রী শঙ্খ ঘোষ প্রায় সাত দশক ধরে আধুনিক বাংলা সাহিত্যজগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র। গত বছর একুশে মে, ২০২১ কোরোনার কারণে তাঁকে আমরা হারিয়েছি। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সেটি ছিল এক অন্ধকারময় দিন, এক নক্ষত্রপতনের দিন। পঞ্চাশের দশকের কবিদের মধ্যে আমরা আগেই হারিয়েছি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শামসুর রহমান, বিনয় মজুমদার প্রমুখকে। আর জার্মানিতে মাত্র কয়েক মাস আগে ২০২০-র নভেম্বরে প্রয়াত হলেন অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। একুশের এপ্রিল একুশ, বাঙালির নিজস্ব বিবেক ও সত্তাপ্রতিম এই কবিকেও অতিমারী ছোবল দিয়ে কেড়ে নিল।
কবি হিসেবে শঙ্খ ঘোষ প্রবাদপ্রতিম। তিনিই একমাত্র সাহিত্য-ব্যক্তিত্ব যিনি বহু পুরস্কারের সঙ্গে পদ্মভূষণ (২০১১), সাহিত্য আকাদেমি (১৯৭৭), জ্ঞানপীঠ (২০১৬), ও সরস্বতী সম্মানও (১৯৯৮) পেয়েছেন। তাঁর কবিতার ভাষা, শব্দ, বাক্য ও পংক্তি যেন আমাদের মুখে মুখে প্রবাদ-প্রবচন হয়ে গেছে। যেমন, ‘আয় সবে বেঁধে বেঁধে থাকি;’ ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ, রক্তে জল ছলছল করে;’ ‘আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক;’ ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে;’ ‘শব্দ কুহক খোলা আজান নৌকা কাঙাল;’ ‘নিওন আলোয় পণ্য হল যা কিছু আজ ব্যক্তিগত;’ ‘রাস্তা কেউ দেবে না, রাস্তা করে নিন/ মশাই দেখছি ভীষণ সৌখিন!’ এমনকী তাঁর কবিতার বইগুলির নামও যেন এক একটি ছন্দময় বাক্য – প্রবাদ কবিতা — যেমন, ‘তুমি তো তেমন গৌরী নও;’ ‘নিঃশব্দের তর্জনী;’ ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ;’ ‘ধুম লেগেছে হৃদকমলে;’ ‘মূর্খ বড়ো সামাজিক নয়;’ ‘শবের ওপর শামিয়ানা;’ ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে;’ ইত্যাদি।
শুধু কবিতার ভাষা বা ছন্দ নয়, তাঁর গদ্য, ‘এখন সব অলীক;’ ‘ইছামতীর মশা;’ ‘এ আমির আবরণ;’ ইত্যাদি অত্যন্ত সাবলীল ও প্রাঞ্জল — যেন দক্ষিণের বারান্দার এক ঝলক খোলা হাওয়া। সেই গদ্যে তিনি রবীন্দ্রবিষয়ক কিংবা বিদ্যাসাগরকে নিয়ে যেমন মননশীল প্রবন্ধ লিখেছেন, তেমনি সরল সহজ কিশোর -শিশু উপন্যাসও লিখেছেন। লিখেছেন জাদুময় সেই ভাষায় স্মৃতিকথা, আত্মকথা, ভ্রমণ, আয়ওয়ার ডায়েরি, এমনকী সিনেমা বা সমসাময়িক বিষয়েও অনেক লেখা। বলাই বাহুল্য, সর্বত্র তাঁর লেখনী সাবলীলতার সঙ্গে সঙ্গে অত্যন্ত মনোগ্রাহী, তাৎপর্যপূর্ণ, এবং প্রাসঙ্গিক।
শঙ্খবাবুরা আট জন ভাই বোন। আদি দেশ বরিশাল হলেও, বড় হয়েছিলেন পাবনা জেলার পাকশীতে। পাকশী আধা শহর-গ্রাম। তাঁর বাবা ছিলেন সেখানকার স্কুলের হেড মাস্টারমশাই। ১৯৪৭এ দেশভাগের আগে পর্যন্ত শঙ্খবাবু ওখানে ছিলেন এবং সেখান থেকেই ম্যাট্রিকুলেশন পাস্ করেন। তারপর কলকাতায়। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়া, তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেশভাগের পর, ১৯৪৭ থেকে এপার-বাংলায় বাস হলেও প্রথম প্রথম এবং পরেও বাসে, ট্রেনে, পথে উদ্বাস্তু / বাস্তুহারা এই শব্দগুলি তাঁকে নাড়া ও পীড়া দিয়েছে আজীবন। মনে হয়েছে, ভৌগোলিক সীমারেখাই কি বুকের মাঝে সীমারেখা আঁকে আজন্মের চেনা জন্মভূমির গণ্ডিকে ঘিরে? দেশভাগজনিত বাস্তুহারার বেদনা যেমন ছুঁয়ে গেছে তাঁর লেখায়।
তেমনি বারবার জল ও জলের নানান আভাস এসেছে লেখায়। মনে আছে, প্রশ্ন করলে বলেছিলেন, ছেলেবেলায় খেলতে খেলতে একবার জলে পড়ে যান। বোধহয় ডুবে যাচ্ছিলেন। তলিয়ে যাবার সেই স্মৃতি, অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি আজীবন ঘুরে এসেছে তাঁর। খুড়তুতো দিদি চুলের মুঠি ধরে কোনোরকমে ডাঙায় তুলে আনেন। ডুবন্ত মানুষের তলিয়ে যাবার জ্বলজ্বলে অভিজ্ঞতা তাই যেন স্থায়ী চিহ্ন হয়ে রয়ে গেছে অনেক লেখাতেই।
জল তাঁর কবিতায় নানান অনুষঙ্গে উপস্থিত বারবার। যেমন,
“বালির গভীর তলে ঘন হয়ে বসে আছে জল
এখানে ঘুমোনো এতো সনাতন, জেগে ওঠা, তাও”
কিংবা,
“পা-ডোবানো অলস জল, এখন আমায় মনে পড়ে?
কোথায় চলে গিয়েছিলাম ঝুরি-নামানো সন্ধ্যা বেলা?…” (‘অলস জল’)
আজকের সাহিত্য আসরে আমরা এই আলোচনার পাশাপাশি তাঁর কিছু কবিতাও পড়লাম:
বাবরের প্রার্থনা / মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে/ তুমি কি কবিতা পড়ো / পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ/ নিচু হয়ে এসেছিলো যে মানুষ অপমানে / ভয়/ মন্ত্রীমশাই ও লজ্জা।
অনুষ্ঠানটি পরিবেশনায় : উদ্দালক /শ্যামলী ও সুমিতা।