রেলরঙ্গ
(ফেস বুকের শ্রী অভিজিৎ ভট্টাচার্যের পোস্ট থেকে : কৃতজ্ঞতা স্বীকার ) / ডানকুনি নিবাসী শ্রী সোমেন রায়ের সৌজন্যে
আমি চিরকালই লোকাল ট্রেনের নিত্যযাত্রীদের ভয়ানক শ্রদ্ধা করি। তাদের রসালাপ, কৌতুক এবং টানা কথা বলে যাওয়ার ক্ষমতা আমাকে মুগ্ধ করে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় হাওড়া স্টেশানে ট্রেন এসে দাঁড়াবার পর বিদ্যুৎগতিতে কামরা প্রবেশ করে সর্বদাই দেখি প্রায় সমস্ত সিটে থরে থরে নিত্যযাত্রী বসে আছেন। কেউ ভারি মনোযোগ দিয়ে সান্ধ্যদৈনিক পড়ছেন। কেউ মুড়িবাদাম খাচ্ছেন। এক একটা করিৎকর্মা গ্রুপের তো দু-তিন হাত তাস অবধি খেলা শেষ। লোকাল ট্রেনের তিনজনের সিটে আমি সদাসর্বদা চতুর্থস্থান অধিকার করে থাকি…
জানলার পাশের মহার্ঘ সিটটি সাধারণত জাগতিক বিষয় থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখা দার্শনিকদের নিজস্ব হয়। ওনারা নিস্পৃহ নিত্যযাত্রী। পাশের দেওয়াল আর উরুর মধ্যে ইঞ্চিখানেক বাতাস চলাচলের রাস্তা। সেটি পরিচিত কণ্ঠ ছাড়া সচারচর অবলুপ্ত হয় না। বহুবছর আগে এমনই এক জানলার পাশে বসে থাকা নির্লিপ্ত ও গম্ভীর দার্শনিককে অপসৃয়মান্ ট্রেনের সাথে সমান্তরাল ছুটন্ত এক আনপড় যাত্রী আকুলস্বরে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘দাদা, বালি ধরবে তো?’ পলক ফেলার আগে দার্শনিকের আত্মবিশ্বাসী উত্তর, ‘সিমেন্ট ভালো হলেই ধরবে..’
গতপরশুর ঘটনাটি অবশ্য এতটা নৃশংস নয়। সন্ধে সাতটা সাতচল্লিশের বর্ধমান লোকাল ভায়া কর্ড। যথারীতি চতুর্থ পজিশনে অবতীর্ণ হয়ে আধঝোলা অবস্থায় বসে। চারিদিকে এক বিরাট টিম। নিকটবর্তী জানলার ধারে এক স্বজনপরিবৃত যুবক, বছর তিরিশেক বয়স। আমার স্বল্পবুদ্ধিতেই বুঝতে পারছি তুমুল জনপ্রিয়, অক্লান্তভাবে কথা বলে চলেছেন। আমিও মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি তার দিকে। ট্রেন ছাড়তে তখনও আইনত মিনিট পাঁচেক…
হঠাৎ দেখি, যুবকটি শশব্যস্ত হয়ে একজনকে ডাকছেন, ‘ও দাদা, ও দাদা’
দুলকিচালে জানলার দিকে এগিয়ে এলেন এক মাঝবয়সী রেলপুলিশ। চেহারায় নিজের সাথে সাদৃশ্য দেখে সবে পুলকিত হতে যাচ্ছি, যুবকটি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ও দিকে যাচ্ছেন?’
-হুঁম
– শুনুন না, ওনাকে একটু বলে দিন, আমি বসে গেছি, এবার ট্রেনটা ছেড়ে দিক’
রেলপুলিশ ভদ্রলোক থতমত খেয়ে আশেপাশে তাকিয়ে বললেন, ‘কাকে?’
– আরে ড্রাইভারকে, ড্রাইভারকে। বলে দিন আমি সিট পেয়ে গেছি, এবার ট্রেনটা ছেড়ে দিক্..’
পলক ফেলার আগে ভদ্রলোক ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। একটা সাধারণ কথা একজন নিরীহ মানুষকে অমন প্রতিহিংসাপরায়ণ ক্ষ্যাপাটে পুলিশ করে তুলতে পারে, এ আমার কল্পনায়ও ছিল না। তিনি পরিত্রাহি গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘য়্যায়ক্ চড় মারবো, হারামজাদা। দাঁত ফেলে দেবো। ইয়ার্কি মারা হচ্ছে আমার সাথে। জানোয়ারের বাচ্চা, জানিস আমি কী করতে পারি?’
যুবকটি সমাহিত মুখে এবং নির্বিকার গলায় বললেন,’আরে কিছু করতে হবে না, শুধু বলে দিন, আমি সিট পেয়ে গেছি…’
কামরায় থিকথিকে ভিড়, আর বাইরে সেই পুলিশ তখন একক নৃত্যশিল্পী হয়ে জানলার অ্যালুমিনিয়াম তারের জাল খিমচে খিমচে ধরছেন।
অশ্রাব্য গালিগালাজের সাথে শুধু ভেসে আসছে ‘আমি বলবো, অ্যাঁ, আমি বলবো!!!’
যুবকটি তার আবেদন সামান্য পরিবর্তন করে বললেন,’আপনার সাথে কথা বন্ধ থাকলে বলবেন না। কিন্তু তার জন্য এত ফুটেজ খাওয়ার কী আছে রে বাওয়া!’
বাইরের অনেকেই এবার পুলিশ ভদ্রলোককে থামাবার চেষ্টা করছেন। তিনি হাতের লাঠিটা দিয়ে প্রবল আক্রোশে জানলার তারজালিতে মারলেন। তারপর হঠাৎ কেমন হাওয়া বেরোনো বেলুনের মতো নিস্তেজ হয়ে হাঁপাতে লাগলেন…
আচমকাই ট্রেনের শরীর দুলে উঠল… প্ল্যাটফর্ম সরে যেতে আরম্ভ করল… যুবকটি খুব উদ্বিগ্ন মুখে সামান্য উঁচু স্বরে অনুযোগের সুরে বলে উঠলেন, ‘সরকারী সম্পত্তি বাঁকিয়ে দিলেন, স্যার!’
ভদ্রলোকের ক্লান্ত, বিধ্বস্ত মুখ থেকে আলগোছে খসে পড়ল,’হা-রা-ম-জা-দা’
ততক্ষণে নিত্যযাত্রীবোঝাই ৭.৪৭য়ের কর্ডলাইন বর্ধমান লোকালের সদ্য আঘাতপ্রাপ্ত এক জানলা দিয়ে নতুন ঋতুর আগমনী বাতাস এসে চোখেমুখে লাগছে…
====================================================
ডানকুনি নিবাসী শ্রী সোমেন রায়ের সৌজন্যে/ ছবির সৌজন্য : আন্তর্জাল