রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর গান: সুমিতা বসু
কবির ১৬১তম জন্মদিনে যদি মননে শ্রবণে ও ভাবনায় তাঁকে স্মরণ করতে চাই, প্রথমেই মনে আসে তাঁরই লেখা তাঁর কত গান, যা রবীন্দ্রসংগীত বলে সর্বজনবিদিত। জন্মদিনের অর্ঘ্য তাই তাঁরই গান দিয়ে, ‘চিরনূতনেরে দিল ডাক, পঁচিশে বৈশাখ।’ তিনি নিশ্চিত জানতেন তাঁর সকল শিল্পকর্মের মধ্যে সব থেকে স্থায়ী ও যুগোত্তীর্ণ তাঁর গান। সেই ২০০০এর বেশী গানগুলি শ্রোতার সব অবস্থার সঙ্গী। তারা যেমন শোকে- দুঃখে, প্রেমে -আনন্দে, প্রভাতে- নিশিতে আছে, তেমনি আছে পূজায়, প্রেমে, প্রকৃতিতে, অনুষ্ঠানে, স্বদেশচেতনায়। আর এই গানের সূত্র ধরেই আমরা তাঁর জীবনকাহিনির এক সুন্দর ও বিশ্বাসযোগ্য প্রতিকৃতি তৈরি করে নিতে পারি। শঙ্খ ঘোষ তাঁর ‘দামিনীর গান’ বইটিতে উল্লেখ করেছেন রানী চন্দের বইতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রিয় ভাইপো শিল্পীগুরু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা। অবনীন্দ্রনাথ নাকি বলতেন, ‘তোমরা সব রবিকা’র জীবনী খুঁজছ, রবিকা’র গানই তো তাঁর জীবনী। সুর ও কথার অন্তরে তাঁর জীবন্ত ছবি ওখানেই পাবে।’
মনে রাখতে হবে, রবীন্দ্রনাথের গান কিন্তু শুধু কথার নয়, নয় শুধু সুরের। রবীন্দ্রসংগীত একান্তভাবেই উপলব্ধির, বোধের, অনুভবের। সুর ও কথার যুগ্ম স্রোতে পাঠক, শ্রোতা ও গায়কের মনে আনে সেই অনুভূতির ব্যঞ্জনাময় অনন্তের দ্যোতনা। রবীন্দ্রসংগীতের বৈচিত্র্য ও ব্যাপ্তি একই সঙ্গে সুদূরপ্রসারী ও গভীর। এর মধ্যে অনেকগুলিই আগে কবিতা হিসেবে লেখা হলেও, পরে সুরারোপিত হয়ে গানের জগতেও জায়গা করে নিয়েছে নিজের গরিমায়।ধরা যাক, ‘সানাই’ কাব্যগ্রন্থে ‘গানের খেয়া’য় লিখেছেন,
‘যে গান আমি গাই
জানি নে সে
কার উদ্দেশে।
যবে জাগে মনে
অকারণে
চপল হাওয়া
সুর যায় ভেসে
কার উদ্দেশে।
ঐ মুখে চেয়ে দেখি,
জানি নে তুমিই সে কি
অতীত কালের মূরতি এসেছ
নতুন কালের বেশে।’
আরো অনেক কবিতা ও গানের মতোই, দু’একটি কথা অদলবদল করে এই কবিতাও গানের রূপ পেয়েছে ভৈরবী সুরের মধ্যে দিয়ে। কবির বুকের মাঝে আজীবন যে অসীমের প্রতি অধরা ভাবনা তাঁকে পাগলপারা করে ছুটিয়ে নিয়ে গেছে তার প্রকাশ এখানেও—
‘আমি যে গান গাই জানি নে সে কার উদ্দেশে
যবে জাগে মনে অকারণে চঞ্চল হাওয়ায়, প্রবাসী পাখি উড়ে যায়…’
রবীন্দ্রসংগীত নিবিড়ভাবে শুনলে এই অরূপ, অসীম, অব্যক্ত হাতছানির আভাস অত্যন্ত সুস্পষ্ট ।
রবীন্দ্রনাথ নিজে বলেছিলেন, ‘গানের কথাকেই সুরের দ্বারা প্রষ্ফুটিত করে তোলা সংগীতের মুখ্য উদ্দেশ্য। …আমি আমার গানের কথাগুলিকে সুরের উপর দাঁড় করাইতে চাই…সুর বসাইয়া যাই কথা বাহির করিবার জন্য।’ তাই তাঁর গানে কথা ও সুরের এক অপূর্ব, অনবদ্য ও অচ্ছেদ্য মেলবন্ধন। তাঁর গানের ভাব, ভাবনা, কথা ও অনুভূতি আলোচনার পাশাপাশি তাঁর সমসাময়িকরা বারম্বার বলেছেন, শুধু গান রচনা নয়, গায়ক হিসেবেও তেমনি ছিল তাঁর মধুর উদাত্ত ও দরাজ গলা।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’তে উল্লেখ করেছেন বাবা দেবেন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত উক্তি এবং সেই দিনের স্মৃতি যেদিন তরুণ রবি সব থেকে সম্মানীয় অভিনন্দন পেয়েছিলেন।
‘একবার মাঘোৎসবের সকালে ও বিকালে আমি অনেকগুলি গান তৈরি করেছিলাম। তাহার মধ্যে একটা গান ‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে রয়েছ নয়নে নয়নে।’পিতা তখন চুঁচুড়ায় ছিলেন। সেখানে আমার এবং জ্যোতিদাদার ডাক পড়িল। হারমোনিয়ামে জ্যোতিদাদাকে বসাইয়া আমাকে তিনি নূতন গান সব-কটি একে একে গাহিতে বলিলেন। কোনো কোনো গান দুবারও গাহিতে হইল। গান গাওয়া যখন শেষ হইল তখন তিনি বলিলেন, “দেশের রাজা যদি দেশের ভাষা জানিত ও সাহিত্যের আদর বুঝিত, তবে কবিকে তো তাহারা পুরস্কার দিত। রাজার দিক হইতে যখন তাহার কোনো সম্ভাবনা নাই তখন আমাকেই সে-কাজ করিতে হইবে।” এই বলিয়া তিনি একখানি পাঁচ-শ টাকার চেক আমার হাতে দিলেন।’
রবীন্দ্রনাথের সুবিশাল সঙ্গীতজীবনে পারিবারিক, পারিপার্শ্বিক, সামাজিক, এমনকী আন্তর্জাতিক ঘটনাও গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে মনকে। অতি নিকটজনের মৃত্যু, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক দৈন্য, জমিদারী দেখতে গিয়ে বাংলার পল্লীর দারিদ্র্য ও দুরাবস্থা, তাঁর মন প্রভাবিত ও বিচলিত করেছে বারবার । তাই লেখাতেও পড়েছে স্বাভাবিকভাবে তার ছায়া। ঘটনা প্রবাহে সব সময়ই কবির লেখনী থেকে সৃষ্টি হয়েছে গান, যেমন ধরা যাক ‘এসো এসো হে তৃষ্ণার জল’ গানটি। শান্তিনিকেতনে রুক্ষ বালি জমিতে জলের কষ্ট বরাবর। কবি ১৯১৩ সালে পুত্র রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমেরিকা ভ্রণের সময় এই কূপ খনন পদ্ধতিটি শিখে আসেন। গরমের দাবদাহে ১৯২২ সালে শান্তিনিকেতনে নলকূপ খননের কাজকে উদ্দীপিত করার জন্য কবি লিখে ফেললেন,
‘এসো এসো হে তৃষ্ণার জল,কলকল্ ছলছল্
ভেদ কর কঠিনের ক্রূর বক্ষতল কলকল্ ছলছল্’ —তারপর আর কী ! কাহারবা তালে মিশ্র ইমন রাগে সুর বসিয়ে শান্তিনিকেতনের দুর্দান্ত গরমে অতি কঠিন ও শ্রমসাধ্য কূপ খননও সহজ হয়ে গেল গানের তালে তালে কলকল্ ছলছল্ তাল মিলিয়ে।
তাঁর গানের পর্যায় ভাগ করতে গিয়ে গীতবিতানের গীতিসমুদ্রে অনেক সময়ই শ্রোতাকে দিকভ্রান্ত হতে হয়। আর পর্যায় বিশ্লেষণ করার সময় দেখা যায় একই অনুষঙ্গ বিভিন্ন পর্যায়ে বিন্যস্ত আছে। এই মিশ্রণের কারণে অবশ্য গায়ক ও শ্রোতার পক্ষে গানগুলিকে নিজের মতো করে অনুভব করার ও অনুধাবন করার এক স্বাধীনতা থেকে যায়। রবীন্দ্রসংগীতে প্রেম ও প্রকৃতি, প্রেম ও পূজা অনেক সময় মিলেমিশে এক। আসলে এর মূল ভাবনায় কবির যে দর্শন কাজ করেছে, সেটি তার বালকবয়সেই পিতার থেকে পাওয়া উপনিষদয়ী বিশ্বাস। তাঁরই ভাষায়, ‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো, সেই তো তোমার আলো’ অথবা ‘জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ/ ধন্য হল ধন্য হল মানবজীবন’, ‘আমি তোমারি মাটির কন্যা, জননী বসুন্ধরা/ তবে আমার মানবজন্ম কেন বঞ্চিত করা’, ‘চিরসখা, ছেড়ো না মোরে ছেড়ো না।
সংসারগহনে নির্ভয়নির্ভর, নির্জনসজনে সঙ্গে রহো’ —এই দার্শনিক ভাবনারই উৎসমূল।
আরো একটি লক্ষণীয় বিষয়, তাঁর গানের প্রায় প্রতিটি পর্যায়ে ‘সকাল‘ ও ‘সন্ধ্যা’র সাংকেতিক ও দ্যোতনাময় ব্যবহার। সকাল কখনও এসেছে শুভ-এর আভাস আবার কখনো বা যা জীর্ণ মলিন তাকে সরিয়ে নুতন উন্মেষ ও প্রতীক। সন্ধ্যার অনুষঙ্গে ধরা পড়েছে একাকিত্ব, শূন্যতা, অবসন্নতা, বিষণ্ণতা। আর এসেছে জীবন-মৃত্যুর আলোছায়া। মৃত্যুকে তিনি উপনিষদের ঋষির মতো হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিলেন, ‘ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।’ ১৯০১ সালে লিখেছিলেন, ‘তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যত দূরে আমি ধাই / কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথা বিচ্ছেদ নাই’ …আসলেই তো তাই সেই পূর্ণতার মধ্যে খন্ডতাকে বিচ্ছিন্ন করে দেখলেই যত অনিশ্চয়তা, দুর্ভাবনা। মনে প্রাণে যদি স্থির বিশ্বাস থাকে, কবির ভাষায়, ‘হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে যাহা-কিছু সব আছে আছে —
নাই নাই ভয়, সে শুধু আমারই, নিশিদিন কাঁদি তাই‘ তখন কোনো ভয় ভাবনাই আর স্পর্শ করতে পারে না। কারণ, ‘আনন্দাদ্ব্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে,’ জীবন শুধুই আনন্দময়, পূর্ণময়।
মানুষের জীবনের প্রতিটি অবস্থার ও অনুভূতির সুরারোপিত অনুরণন আমরা পাই রবীন্দ্রসংগীতে। পাই পূজা, প্রেম ও বিশেষত প্রকৃতি পর্যায়ে। বুদ্ধদেব বসুর কথায়, ‘ঋতুর গানগুলো রাবীন্দ্রিক সৌরভে সবচেয়ে ভরপুর। …আকাশে মেঘ করে, নদীতে ছায়া পরে, একা চাঁদ আকাশে পাড়ি দেয়, হাওয়ায় গাছের পাতা দোলে, হঠাৎ একটু রোদের ফালি এসে ঘরে পড়ে, সূর্যাস্ত আকাশে সোনা ছড়ায় আবার শীত সন্ধ্যার শূন্যতা আকাশকে রিক্ত করে দেয় –যখন যা চোখে পরে, যা কিছু মন দিয়ে ছুঁই, সেই সমস্তই বয়ে আনে রবীন্দ্রনাথের কত গানের কত বিক্ষিপ্ত চরণ। তাঁর গান মনে না করে আমরা দেখতে, শুনতে, ভালোবাসতে, ব্যথা পেতে পারি না —আমাদের নিগূঢ় মনের বিরাট মহাদেশের কোথায় কী আছে হয়তো স্পষ্ট জানিনে তবে এটা জানি যে সে মহাদেশের মানচিত্র আগাগোড়াই তাঁর গানের রঙে রঙ্গীন। ‘ (রবীন্দ্রনাথের গান-কবিতা/ রবীন্দ্রসংখ্যা )
খুব ছেলেবেলা থেকেই সুরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের সাঙ্গীতিক পরিবেশে, লিখেছেন, ‘আমার ভাইরা দিনরাত নিজের ভাষায় তত্ত্বালোচনা করেছেন, কাব্যরস আস্বাদনে ও উদ্ভাবনে তাঁরা ছিলেন নিবিষ্ট, চিত্রকলাও ইতস্তত অঙ্কুরিত হয়ে উঠেছে, তার উপরে নাট্যাভিনয়ে কারও কোনও সংকোচমাত্র ছিল না। আর সমস্ত ছাড়িয়ে উঠেছিল সঙ্গীত। বাঙ্গালির স্বাভাবিক গীতমুগ্ধতা ও গীত মুখরতা কোনও বাধা না পেয়ে আমাদের ঘরে যেন উৎসবের মতো উৎসারিত হয়েছিল।’
কথা, তান, লয় থেকে সংগীতের মুক্তি বলতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের মতে রাগ-রাগিণী বিশ্বসৃষ্টির মধ্যে নিত্য আছে। সেইজন্য আমাদের কালোয়াতি গানটা ঠিক যেন মানুষের গান নয়, তাহা যেন সমস্ত জগতের। ভৈঁরো যেন ভোরবেলার আকাশেরই প্রথম জাগরণ; পরজ যেন অবসন্ন রাত্রিশেষের নিদ্রাবিহ্বলতা; কানাড়া যেন ঘনান্ধকারে অভিসারিকা নিশীথিনীর পথবিস্মৃতি; ভৈরবী যেন সঙ্গবিহীন অসীমের চিরবিরহবেদনা; মূলতান যেন রৌদ্রতপ্ত দিনান্তের ক্লান্তিনিশ্বাস; পূরবী যেন শূন্যগৃহচারিণী বিধবা সন্ধ্যার অশ্রুমোচন’
(সঙ্গীতের মুক্তি, সবুজ পত্র, ভাদ্র ১৩২৪; ছন্দ, প্রথম সংস্করণ)
শুধু উত্তর ভারতীয় ধ্রুপদী ও মার্গ সংগীত থেকে নয়, রবীন্দ্রসংগীতের উন্মুক্ত প্রাঙ্গনে ইংরেজি ব্যালাড থেকে কর্ণাটকী সুর, বাংলার নিজস্ব লোকজ কীর্তন, বাউল সবই খুব স্বাভাবিক, সাবলীল ও স্বচ্ছন্দ এক জায়গা করে নিয়েছে। শঙ্খ ঘোষ তাঁর ‘দামিনীর গান’ বইটিতে বলছেন, ‘শিল্প থেকে শিল্পীর ব্যক্তিজীবনে পৌঁছোবার একটি সরল পথও যে পাওয়া যায়, সেটা অবশ্য মিথ্যে নয়। …১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ঘিরে লেখা গানগুলিতে বাংলা তথা ভারতের সেই সময়ের জ্বলন্ত স্বাক্ষর।’
প্রসঙ্গত কয়েকটি গান উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন বাউল সুরে, ‘যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক,আমি তোমায় ছাড়ব না মা
আমি তোমার চরণ করব শরণ, আর কারো ধার ধারব না মা’,
কিংবা সারিগানের সুরে,
‘এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে, ‘জয় মা’ ব’লে ভাসা তরী’।
তবে রবীন্দ্রভাবনায় দেশানুরাগ কোনো মানচিত্রের গন্ডীতে আঁকা, ভৌগোলিক মাটির দাগ কাটা দেশ নয়। সর্বদাই ‘বসুধারে খন্ড ক্ষুদ্র’ করে রাখার বিপক্ষে তাঁর বাণী। আর স্বাধীনতার অর্থ তাঁর কাছে,
স্ব-অধীনতা, আত্ম-উন্মোচন, আত্ম-উদ্ঘাটন, আত্ম-প্রতিষ্ঠা। তাই রাবীন্দ্রিক মূল দর্শন ভাবনায় বারবার ‘নৈবেদ্যে’র সেই বিখ্যাত কবিতাটি ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির, জ্ঞান যেথা মুক্ত ‘ মনে পড়ে যায়। ১৯০৫ সালে লেখা আরো একটি গান মনে পড়ে যায়, যে গানটি বীজমন্ত্রের মতো গান্ধীজী এবং আরো অনেকেরই অত্যন্ত প্রিয় ছিল এবং আজও আছে,
‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে…
যদি আলো না ধরে, ওরে ওরে ও অভাগা,
যদি ঝড়-বাদলে আঁধার রাতে দুয়ার দেয় ঘরে–
তবে বজ্রানলে
আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে একলা জ্বলো রে…
কবি নিজেও নিজের গানে, কবিতায় প্রশমন খুঁজেছেন। মৃত্যুর অল্প কয়েকদিন আগে, ২৭শে জুলাই, ১৯৪১ সকালবেলায়, শ্রুতিলেখনে ‘শেষ লেখা’র ‘ প্রথম দিনের সূর্য প্রশ্ন করেছিল সত্তার নূতন আবির্ভাবে–কে তুমি…’ লেখার পর কবি রাণী চন্দের কাছে শুনতে চেয়েছিলেন নিজেরই এই গানটি, ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা, বিপদে আমি না যেন করি ভয়’, বলেছিলেন, ‘এগুলি মন্ত্রের মতো’— জীবনের মন্ত্র।
কবির জীবনের ও শিল্পকর্মের ধ্যানের ধন প্রাণভোমরাটি লুকিয়ে আছে তাঁর গানগুলিতে যা কথার মাধুর্যে ও সুরের ইন্দ্রজালে পরিপূর্ণ হলেও যুগ যুগান্তর ধরে যা সত্যদ্রষ্টা কবির মর্মবাণী বয়ে নিয়ে যাবে । তাঁর গানই ১৬১ বছরের কবিকে প্রতিনিয়ত চিরনবীন ও প্রাসঙ্গিক করে রেখেছে।
বাংলা ভাষা ও রবীন্দ্রসংগীত একে অপরকে জড়িয়ে নিয়ে আগুনের পরশমণি হয়ে আলোর পথ দেখাবে আগামীকে। ‘মহুয়া’র এই কবিতাটি তারই স্বাক্ষ্য দেয়,
‘শুধায়োনা, কবে কোন্ গান কাহারে করিয়াছিনু দান।
পথের ধূলার পরে
পড়ে আছে তারি তরে
যে তাহারে দিতে পারে মান।
তুমি কি শুনেছ মোর বাণী,
হৃদয়ে নিয়েছ তারে টানি’?
জানিনা তোমার নাম,
তোমারেই সঁপিলাম
আমার ধ্যানের ধনখানি।’