বাংলা ভাষা
সুজয় কর্মকারের কলমে: সৌজন্যে ইন্ডিক হাউস
মোদের গরব, মোদের আশাা
আ মরি বাং লা ভাষা।
এই আমাদের দেশ, এই আমাদের ভাষা। এমন কোথা আর আছে গো! না, নেই।এমন মনভোলানো রূপ,আর দুঃখ শ্রান্তি নাশা ভাষা আর কোথায় আছে? এমন ঘন সবূজ গাছ-পালা,শারদ-প্রাতে শিউলি ফোটা,ঝিলের জলে শাপলা-শালুকের হাসি ,ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ার লুকোচুরি,শিশির স্নাত দূর্বা ঘাসে মুক্তো বিন্দু,দিগন্ত প্রসারিত সবুজ মাঠ,–সবই বাংলার রূপ। এখানে ‘পুষ্পে পুষ্পে ভরা শাখী,পুঞ্জে পুঞ্জে গাহে পাখী। মধুপেরা ‘ফুলের উপর ঘুমিয়ে পড়ে ফুলের মধু খেয়ে। এই রূপ দেখার পর কবির একান্ত বাসনা–‘আমার এই দেশেতেই জন্ম যেন এই দেশতেই মরি’।
‘রূপসী বাংলার’ প্রেমে মুগ্ধ আর এক কবি এমনই মোহিত যে পৃথিবীর অন্য কোন রূপ তাঁকে আর আকর্ষণ করে না….
“বাংলার রূপ আমি দেখয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর;অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছে চেয়ে দেখি ছাতার মতন বড়ো পাতাটির নিচে ব’সে আছে ভোরের দোয়েল পাখি”–
কিংবা——-
“একদিন জলসিড়ি নদীটির পারে এই বাংলার মাঠে বিশীর্ণ বটের নীচে শুয়ে রবো;”
বাংলার রূপে মুগ্ধ আর এক কবি বলেছেন—
“আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে
কখন আপনি
কি অপরূপ রূপে বাহির
হলে জননী।
দেখে দেখে কবির আশ মেটেনা। কবি দেশ-দেশান্তরে ঘুরেছেন।দেখেছেন পাহাড়, নদী, সাগর, মাঠ।
তবুও কবির আক্ষেপ ঝরে পড়ে—
“দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিসের উপর
একটি শিশির বিন্দু”।
মুগ্ধ কবি ভুলতে পারেন না কিছুই।
বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল…..কবির কন্ঠে সুধা ঢালে।আপনমনে কবি গেয়ে ওঠেন—–
“আমার সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালোবাসি
চিরদিন তোমার আকাশ,তোমার বাতাস
আমার প্রানে বাজায় বাঁশী”।
বাংলা ভাষা শুধু আবেগ মথিত করে তাই নয়,এর ভাব এবং মাধূর্য আমাদের হৃদয়েও ঢেউ তোলে—-
পদ্মার ঢেউ রে—–
মোর শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা,
যারে—–।
বাংলার প্রকৃতি,বাংলার,আকাশ,বাতাস, পাহাড় নদী-এক অসামান্যা রূপ নিয়ে হাজির আমাদের সামনে।
‘তোমার মতন এত অপরূপ সুন্দর কাউকে তো দেখিনি গো আর’।
তাই, ‘একবার দেখি বার বার দেখি, দেখি বাংলার মুখ’।
বাংলার রূপে-আত্মবিশ্বাসী কবি তাই দুরের বন্ধুকে আমন্ত্রন জানান।হৃদয়ের কথা আর কোন ভাষায় এমন করে বাঙ্ময় হয়?——
“তুমি যাবে ভাই – যাবে মোর সাথে,
আমাদের ছোট গাঁয়,
গাছের ছায়ায় লতায় পাতায়
উদাসী বনের বায়;
তুমি যাবে ভাই – যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়”।
************************************
“সোনা সোনা সোনা লোকে বলে সোনা
সোনা নয় ততো খাঁটি
বলো যতো খাঁটি তার চেয়ে খাঁটি
বাংলাদেশের মাটি”।
হ্যাঁ,বাংলাদেশ। সমস্ত বাংলা ভাষাভাষী মানুষের দেশ।’এপার ওপার কোন পারে জানিনা’–আমি সেই বাংলাদেশের কথা বলছি যাদের মুখের ভাষা বাংলা। তা তিনি যে দেশের অধিবাসীই হোন না কেন। এখানে দেশ ভাগের প্রশ্ন নেই,নেই কাঁটাতারের বেড়া। আমাদের দেশ ভাগ হলেও ভাষা ভাগ হয়নি।বাংলা ভাষা সাহিত্যের কেন্দ্র যখানে ছিল এখনও সেখানেই আছ”–সেটা আছে সমগ্র বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসের মধ্যে। এ প্রসঙ্গে ড, মুহম্মদ শহীদুল্লার একটি মন্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে…
“আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশী সত্য আমরা বাঙ্গালী। এটি কোন আদর্শের কথা নয়। এটি একটি বাস্তব কথা”। বাংলাভাষী মানুষ যতদূর পর্যন্ত বসবাস করেন ততদূরই বাংলাভাষার দেশ। বাংলাদেশ।
বিশ্বে প্রচলিত অপ্রচলিত ভাষার সংখ্যা কত সে সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় নি। তবে অনেকে মনে করেন বিশ্বে প্রায় হাজার তিনেক ভাষা প্রচলিত আছে। তার মধ্যে বাংলা এখন বিশ্বের ষষ্ঠতম ও মিষ্টতম ভাষা।প্রায় ৩০ কোটি মানুষ বাংলায় কথা বলে। বাংলাদেশেই একমাত্র দেশ যার জাতীয় ভাষা বাংলা। ভারতের পশ্চিমবাংলা,ত্রিপুরা,আসামের করিমগঞ্জ,কাছাড়,হাইলাকান্দি আন্দামানের নেইল ও হ্যাভলক দ্বীপে বাংলাভাষীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। সিঙ্গাপুরেও বাংলা অন্যতম ভাষা। আমেরিকার লসএ্যাঞ্জেলস,হিউস্টন,শিকাগো ও নিউ ইয়র্ক,বৃটেনের লন্ডনে বাংলা ভাষাভাষী মানুষেরা সংখ্যায় বেশ ভারী।
অষ্ট্রেলিয়ার সিডনিও মেলবোর্ন, কানাডার টরেন্টো ও ভ্যানকুভার, ইতালীর রোম, গ্রীসের এথেন্স,সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর আবুধাবি ও নেপালের কাঠমান্ডু প্রভৃতি স্থানে ছোট ছোট বাংলা টাউন গড়ে উঠেছে– বাংলা সংস্কৃতির কেন্দ্র। সুতরাং আমরা বলতেই পারি,এ ভাষা ছড়িয়ে গেছে সবখানে– সবখানে–সবখানে—-।
বাংলা আমাদের গর্ব।বাংলা ভাষা আমাদের অহংকার। যাঁদের কাছ থেকে উত্তরাধকারসূত্রে এ বাংলা ভাষাকে পেয়েছি –সেই মনীষীদের এবং বাংলা ভাষার স্বাধিকার রক্ষায় যাঁরা জীবন বিসর্জন দিয়েছেন, বরকত সালাম রফিক সহ অন্যান্যরাএবং যাঁরা বাংলা ভাষার প্রচারও প্রসারের কাজে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন-তাদেরকে জানাই আমার প্রনাম ও বিনম্র শ্রদ্ধা।এই সুযোগে “বইয়ের হাট”কেও জানাই আমার কৃতজ্ঞতা-বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষাএবং প্রচারে নিরলস প্রচেষ্টার জন্য।
জীবন ও ভাষা উভয়ে উভয়কে ছেয়ে রাখে।ভাষাই হল জীবনের আশ্রয়,ভাষাই হল জীবনের প্রকাশ। ভাষা গভীরভাবে এবং ব্যাপকভাবে আলোড়িত করে মানুষের স্বপ্ন ও বাস্তবকে। তীব্র ঝাঁকুনিতে অনুভূতি গুলো হাসি-কান্নায় ঝরে পড়ে। আমাদেরকে স্মৃতিমেদুর করে তোলে। আমরা বাংলা ভাষায় কথা কই, বাংলায় হাসি বাংলায় কাঁদি। বাংলায় গান গাই।
তাহলে, চলুন, এবার একটা গান শুনতে শুনতে আলোচনাটা শেষ করি। যারা বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়- স্বজন ছেড়ে জন্মভুমি থেকে দূরে আছেন—এ গান তাদের মনে কষ্টের অনুভূতি জাগাতে পারে–কিন্তু তার জন্য আমি দায়ী নই।দায়ী তিনি যিনি গানটির কথা লিখেছেন———
“একবার যেতে দেনা আমায় ছোট্ট সোনার গাঁয়
যেথায় কোকিল ডাকে কুহু
দোয়েল ডাকে মুহু মুহু
নদী যেথায় ছুটে চলে আপন ঠিকানায়।।
মমতারই শিশিরগুলো
জড়িয়ে থাকে পায়”।
ভাষা সংক্রান্ত তথ্য সূত্র:–
“ভাষার আপন পর”—–
মহম্মদ হবিবুর রহমান।
“একুশের ঘোষণা”