জুতোকাহিনি তথা মে দিবস : অলোক কুমার চক্রবর্তী
ঠিক “জুতো” না হলেও, এই জুতো নির্মাণ-শ্রমিকদের এক বিরাট অবদান রয়েছে আমাদের সভ্যসমাজে, বিশেষত মেহনতী শ্রমিকদের জীবনে। সেটাই বলি।
সবাই জানেন, সাধারণভাবে একজন শ্রমিকের শ্রমদানের বা কাজের সময় “আট ঘন্টা”। এটা বর্তমানে প্রায় সারা পৃথিবীতেই মান্য। চিরকাল কিন্তু এমন ছিল না। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত সর্বত্রই মজদুরদের কাজের সময়ের প্রায় কোথাওই কোনো ঠিকঠিকানা ছিল না। সম্পূর্ণত মালিকপক্ষের ইচ্ছানুযায়ী তাদের কাজের সময় চলত। অমানুষিকভাবে খাটানো ও নির্যাতন চলত। এই অমানবিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে, কাজের জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা স্থির করার দাবি নিয়ে আমেরিকার শিকাগো শহরে, যা বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী, প্রায় ১৩ হাজার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ৩ লক্ষেরও বেশি মূলত জুতা-শ্রমিক বিক্ষোভ জানিয়ে পথে নামেন। তারমধ্যে ৪০০০০ জুতোশ্রমিক পুরোপুরি ধর্মঘট করেন। পুলিশ বিরোধিতা করলে তাদের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ বাধে। এইসময় আন্দোলনকারীদের মধ্যে থেকে কেউ একজন একটি বোমা ছুঁড়লে ব্যাপক হাঙ্গামা হয়। সাতজন পুলিশকর্মী ও চারজন শ্রমিক মারা যান। আহত হন কয়েকশো। শিকাগোর জুতাশিল্পসমৃদ্ধ “হে মার্কেট” অঞ্চলে এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল বলে একে “Hay Market Affair” বলা হয়। শ্রমসময়ের নির্দিষ্টতা নিয়ে দাবি কিন্তু এর পর থেকেই সর্বত্র জোরালো হয়ে উঠতে থাকে।
International Socialist Congress এই দাবি নিয়ে সোচ্চার হয় ১৮৮৯ সালে তাদের প্রথম অধিবেশনে। ১৮৯১ সালের কংগ্রেসে স্থির হয়, এই “হে মার্কেট অ্যাফেয়ার” -কে একটি বাৎসরিক পালনীয় ঘটনা (Annual Event) হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হবে। শ্রমের সময়সীমা ৮ ঘন্টায় নির্দিষ্ট করার দাবি জোরালো হতে থাকে। এই Annual Event পালনের সময়ই ১৮৯৪ সালের ৫ মে আমেরিকার উইসকনসিন রাজ্যের মিল্যকী শহরে আন্দোলনকারীদের ওপর সামরিক বাহিনীর নির্বিচার গুলিচালনায় এক স্কুলছাত্র, মুরগিকে খাবার দেওয়ায় ব্যস্ত এক সাধারণ নাগরিকসহ ১৩ জন নিহত হন। পুলিশ প্রায় আড়াইশোজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে। একপেশে বিচারে আদালত ৪ জনকে ফাঁসির আদেশ দেয়, যা কার্যকর করা হয়। এই জঘন্য ঘটনা “বিচারবিভাগের কলঙ্ক” বা “Miscarriage of Justice” বলে কুখ্যাত হয়ে রয়েছে।
ইতিমধ্যেই বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় কাজের সময় “৮ ঘন্টা” হিসেবে মান্যতা পেতে শুরু করেছে। ১৯০৪ সালে International Socialist Congress-এর ষষ্ঠ অধিবেশনে (6th Congress) সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ও সমস্ত সমাজতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক দল ও শ্রমিক সংগঠন (Trade Union)-কে নির্দেশ দেওয়া হয় যে, বিশ্বের সর্বত্রই কাজের সময় নির্দিষ্ট থাকবে একদিনে সর্বাধিক ৮ ঘন্টা এবং এই দাবি যেহেতু মে মাসে প্রথম উঠেছিল, তাই তাকে স্মরণ করে প্রতি বছর মে মাসের ১ তারিখ “শ্রমিক দিবস” হিসেবে পালন করতে হবে। সংগ্রাম ও দিনটিকে সম্মান জানাতে ওইদিন কোথাও কাজ করা হবে না। অবশ্য কোনও দেশ চাইলে নিজেদের সুবিধা মতো পরিবর্তে অন্য কোনো দিন বেছে নিতে পারে। World Labour Organization-ও এই প্রস্তাবকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
আমেরিকা ও কানাডা সেপ্টেম্বর
মাসের ১ তারিখে শ্রমিক দিবস
পালন করে। দুঃখের বিষয়, আমাদের এই ভারতবর্ষে, যেখানে শ্রমিকসংখ্যা সর্বাধিক, মাত্র ৩-৪টি রাজ্য ছাড়া কোথাও এই আন্তর্জাতিক সম্মানের দিনটি পালিত হয় না।
তাই বলা যায়, এই ৮ ঘন্টা কাজের অধিকার, যা আজ সারা পৃথিবীর শ্রমিকশ্রেণী উপভোগ করছেন, তা এই জুতা-শ্রমিকদেরই আন্দোলনের অবদান।
copyright অলোক কুমার চক্রবর্তী/ Photos from Internet: respectfully acknowledged.
অনবদ্য।
মে দিবসের এই কথা আমরা অনেকেই জানিনা। লেখক অলক কুমার চক্রবর্তীকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।