ছদ্মনাম: লেখকের কলমে ও চোখে
সভ্যতার সূচনা পর্ব থেকেই ‘নাম’ হলো মানুষের এক বিশেষ ব্যক্তিগত সম্পদ। সম্পদের শ্রীবৃদ্ধি করা এবং যত্ন নেওয়া মানুষেরই ধর্ম। নাম ব্যক্তিত্ব বাড়ায় আবার কমায়ও। উদ্ভট নাম ছেলে বা মেয়ের জীবনে বিড়ম্বনা ডেকে আনতে পারে! তাই বাবা মায়ের কাছে ছেলে মেয়ের নামকরণ একরকম মনস্তাত্ত্বিক চাপ। কবি যতই বলুন নামে কী এসে যায়! নাম নিয়ে আমাদের মাথা ঘামাতেই হয়।
বাঙালী বিদ্যাভিমানী জাতি। নামবিলাস আমাদের স্বভাব ধর্ম। আমরা নাম নিতেও জানি আবার দিতেও জানি! স্কুলের মাষ্টারমশাই থেকে পাড়াপড়শি, বন্ধুবান্ধব সকলকে তাদের কাজ, আচরণ বা স্বভাব গত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী একটা করে নাম দেওয়া আমাদের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে! তবে সেই নামকরণের মধ্যে থাকে গভীর তাৎপর্য, মজা, কৌতুক এবং কাব্য। অন্নদাশঙ্করের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘খোকা হাকিম’, দিলীকুমার রায়কে ‘পাগলা জগাই’ আর গুরুসদয় দত্তকে বলা হত ‘রায়বেঁশে দত্ত’!
সে যাই হোক। পিতৃদত্ত নামও আমাদের মাঝে মাঝে লুকিয়ে রেখে অন্য নামের আড়াল নিতে হয়। সে হল ‘ছদ্মনাম’। এটি বহু উদ্দেশ্যসাধক। একটা নামে আমাদের চলে না।আমাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য বিভিন্ন নাম তথা ছদ্মনামের দরকার পড়ে। কোন এক কবির কবিতা সম্পাদক বার বার ফেরত পাঠাচ্ছেন। বন্ধু পরামর্শ দিল কোন মেয়েের নাম দিয়ে পাঠাতে। বন্ধুর কথায় কবি সেই ফেরত পাঠানো কবিতা ‘নীহারিকা দেবী’ নাম দিয়ে আবার পাঠালেন। কিআশ্চর্য! একটি মেয়ের নাম দেখেই কবিতা গৃহীত হল এবং ছাপা হল! তখনকার সেই ‘নীহারিকা দেবী’ হলেন কবি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত!
আমরা যদি রবীন্দ্রনাথের কথাই ধরি তাহলে দেখব নয় নয় করে তিনিও প্রায় গোটা নয়েক ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন। কখনো খেয়াল খুশিতে। কখনো উদ্দেশ্য ছিল বলে। ‘দিকশূন্য ভট্টাচার্য’, ‘অকপট চন্দ্র ভাস্কর’, আন্নাকালী পাকড়াশী’, ‘বাণীবিনোদ বন্দোপাধ্যায়’, ‘ভানু সিংহ’ নামে তিনি লিখেছেন। এছাড়া ‘শ্রীমতী মধ্যমা’, শ্রীমতী কনিষ্ঠা, নবীন কিশোর শর্মণ’ এবং’ ষষ্ঠীচরণ দেববর্মা’ তাঁরই ছদ্মনাম বলে অনেকেই মনে করেন।
ছদ্মনামের সংখ্যা বিচারে শনিবারের চিঠির সম্পাদক অশোক ভট্টাচার্য কম যান না! তিনি আটটি নাম ব্যবহার করেছেন। ‘পিঠটান চম্পটি’, ‘মধুকর কুমার কাঞ্জিলাল’, ‘নটনারায়ণ’, ‘শুভগ্রহ’, ‘অবেদন’, ‘ভজনরাম পাহাড়ী’, ‘শ্রী শঙ্করাচার্য’, ও ‘আত্মানন্দ পাহাড়’।
শরৎচন্দ্র তিনটি নাম ব্যবহার করেছেন। ‘অনিলাদেবী’ ‘পরশুরাম’ ও ‘অনুপমা’। আমরা জানি প্যারীচাঁদ মিত্র হয়েছিলেন ‘টেকচাঁদ ঠাকুর’, কালীপ্রসন্ন সিংহ ‘হুতোম প্যাঁচা’ ইন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় ‘পঞ্চানন্দ’, প্রমথ চৌধুরী হয়েছিলেন ‘বীরবল’। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ‘নবকুমার কবিরত্ন’, রবীন্দ্রনাথ মৈত্র হয়েছিলেন ‘দিবাকর শর্মা’, ‘বান্দা ছমছের আলি’। ‘ পরশুরাম’ হয়েছিলেন রাজশেখর বসু। ‘কমলাকান্ত’ নাম নিয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র।
রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ‘পীরু’ ও ‘কৃষ্ণসুন্দর’ নামে লিখেছেন। ‘বিনমা’ নামে লিখেছেন যোগাশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি। ‘শান্তনু’ নাম ব্যবহার করেছেন সুধীর কুমার চৌধুরী। শান্তা দেবী লিখেছেন ‘মঙ্গলচন্দ্র শর্মা’ নামে। আলতাফ চৌধুরীও একাধিক নাম ব্যবহার করেছেন ‘কুদরত’ ‘ইছমেদ ছুরোমদ্দি’ ‘সেলিম’ ও ‘খয়ের খাঁ’। বলাই চাঁদ মুখোপাধ্যায়ের ছদ্মনাম ‘বনফুল’। ‘বৃহন্নলা বসাক’ নামেও তিনি লিখেছেন।পরিমল গোস্বামী ‘পরাশর শর্মা ‘ এবং তারাশঙ্কর হয়েছেন ‘হাবু শর্মা’।
একাল সেকাল সবকালেই কবি সাহিত্যকরা অল্প বিস্তর ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন। প্রেমেন্দ্র মিত্র-‘কৃত্তিবাস ভদ্র’, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায -‘লেখরাজ সামন্ত’, মনীষ ঘটক-‘যুবনাশ্ব’, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী- ‘মহাস্থবির’, মোহিতলাল মজুমদার – ‘সত্যসুন্দর’, নীহার রঞ্জন গুপ্ত- ‘বানভট্ট’, নারায়ন সান্ন্যাল- ‘বিকর্ণ’, নিখিল সরকার – ‘ শ্রীপান্থ’, সুবোধ ঘোষ- ‘সুপান্থ’, নারায়ন গঙ্গোপাধ্যায়- ‘সুনন্দ’, সৈয়দ মুজতবা আলী -‘ওমর খৈয়াম’, সমরেশ বসু -‘কালকূট’ মীর মোশারফ হোসেন -‘গাজী মিঞা’ ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন।
অন্যদিকে ‘অবধূত’ নাম নিয়েছেন দুলাল মুখোপাধ্যায়।’ কাকাবাবু’-প্রভাতকিরণ বসু, ‘কালপেঁচা’-বিনয় ঘোষ, ‘জরাসন্ধ’- চারুচন্দ্র চক্রবর্তী, ‘দৃষ্টিহীন’-মধুসূদন মজুমদার, ‘ধনঞ্জয় বৈরাগী’-তরুণ রায়, ‘নিরপেক্ষ’- অমিতাভ চৌধুরী, ‘বিরূপাক্ষ’- বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, ‘বেদুইন’- দেবেশ রায়, ‘মৌমাছি’- বিমল চন্দ্র ঘোষ, ‘যাযাবর’-বিনয় মুখোপাধ্যায়, ‘রূপদর্শী’- গৌর কিশোর ঘোষ, ‘স্বপনবুড়ো’-অখিল নিয়োগী, ‘উদয়ভানু’-প্রাণতোষ ঘটক। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়- ‘নীললোহিত’ এবং ‘ সনাতন পাঠক’। ‘চন্দ্রহাস’ নাম নিয়েছিলেন শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়। শরৎচন্দ্র পন্ডিতকে লোকে ‘দাদাঠাকুর’ নামেই বেশি চেনে।
অনেকে মনে করেন বিখ্যাত হবার সর্টকাট রাস্তা হল ‘ছদ্মনাম’ নেওয়া। এতে অনেকের ঔৎসুক্য অর্জন করা যায়। তবে শ্রুতিমধুর ও তাৎপর্যপূর্ণ নামকরণ যেমন একটা কঠিন কাজ তেমনি একটি যুতসই ‘ছদ্মনাম’গ্রহণও কঠিন। তবে একাজে যে অনেকেরই মুন্সিয়ানা আছে তা বর্তমানে ফেসবুকে চোখ রাখলেই দেখা যায়। আহা! কি সব নাম! নাম শুনলেই মনে কত রকমের ভাব আসে! মনে হয় ছদ্মনামের ট্র্যাডিশন আজও সমানে চলেছে! হ্যারি পটার-এর সৃষ্টিকর্তার নাম কি J.K. Rowling? নাকি তাঁর আসল নামটা জানেন সকলে?
রচনা: সৌজন্যে ইন্ডিক হাউস
ছবির সৌজন্য : আন্তর্জাল