ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়
বাঙালি হিসেবে আমরা অনেক প্রতিভা পেয়েছি। তাঁদের জীবনই তাঁদের বাণী। আবার তাঁদের কথা একটু চর্চা করলে, আমরা অনুপ্রাণিত হই, সমৃদ্ধ হই। প্রবাস বন্ধুর এই উদ্যোগ আশাকরি সকলের ভালো লাগবে।
১৮৯০-এর ২৬ নভেম্বর‚ হাওড়া জেলায় বাংলার সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, এই ভাষাবিদের জন্ম। তিনি ছিলেন আশৈশব তীক্ষ্ণ মেধাবী | তাঁর বাবা হরিদাস চট্টোপাধ্যায় সম্পন্ন ব্যক্তি হয়েও তাঁকে মতিলাল শীলের ফ্রি স্কুলে পাঠিয়েছিলেন | আসলে তখনকার দিনে আজকালকার মতো কে কোথায় পড়ছে, এই সব স্টেটাস-এর ব্যাপার ছিল না।
১৯০৭ সালে কলকাতার সেই স্কুল থেকেই এন্ট্রান্স উত্তীর্ণ হলেন সুনীতিকুমার | এন্ট্রান্স পরীক্ষায় (তখনকার স্কুল ফাইনাল) পেয়েছিলেন ষষ্ঠ স্থান | তারপর স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে FA ( প্রি ইউনিভার্সিটি) তে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন, মেধা তালিকায় স্বগৌরবে তৃতীয় স্থান | পড়াশোনা ফ্রি স্কুলে, অথচ মাত্র ২৩ বছর বয়সেই অধ্যাপক হয়েছিলেন তিনি ! কলেজে এক বছর পড়াতে না পড়াতেই সুনীতিকুমার ডাক পেলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে | পাঁচ বছর সেখানে সুনামের সঙ্গে শিক্ষকতা করার পরে তিনি আবার ফিরে গেলেন ছাত্রাবস্থায় | পাড়ি দিলেন ব্রিটেন | লন্ডন ইউনিভার্সিটিতে পড়লেন ফোনোলজি‚ প্রাকৃত‚ ইন্দো-ইউরোপীয়ান লিঙ্গুইস্টিকস‚ পার্সিয়ান‚ ওল্ড আইরিশ‚ গথিক এবং আরও অন্য ভাষা | এরপর প্যারিসে গিয়ে গবেষণা করেছিলেন স্লাভ‚ ইন্দো ইউরোপীয়ান লিঙ্গুইস্টিক্স‚ গ্রীক ও ল্যাটিন ভাষায় | তাঁর শিক্ষক ছিলেন বিশ্ববন্দিত ভাষাবিদ জুল ব্লোশ | তিন বছর পরে যখন দেশে ফিরলেন তখন তিনি “ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়” | স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে এই উপাধি দিয়েছিলেন | তিনি ছিলেন বাংলা তথা ভারতের গর্ব। ১৯২২-১৯৫২ অবধি তাঁর অধ্যাপনায় সমৃদ্ধ হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় | অবসর গ্রহণের পরেও তিনি অলঙ্কৃত করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা পদ | হয়েছিলেন বিশ্বকবির সফরসঙ্গীও | যখন কবি গিয়েছিলেন মালয়‚ সুমাত্রা‚ জাভা‚ বালি-সহ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া সফরে | আচার্য সেখানে ভারতীয় ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন | সাহিত্য অ্যাকাডেমির প্রেসিডেন্ট পদও অলঙ্কৃত করেছেন ভাষাচার্য | ভাষা ও সাহিত্য দু দিকেই বহু আকর গ্রন্থের প্রণেতা আচার্য সুনীতিকুমার | তার মধ্যে বলতেই হয় বাংলা ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা‚ ভারতের ভাষা ও ভাষা সমস্যা‚ জাতি সংস্কৃতি সাহিত্য‚ সংস্কৃতি কী‚ বইগুলোর নাম | পাশাপাশি তাঁর অভিজ্ঞতা ও ভ্রমণ-কাহিনী সমৃদ্ধ বই হল রবীন্দ্র সঙ্গমে‚ ইউরোপ ভ্রমণ‚ দ্বীপময় ভারত এবং পশ্চিমের যাত্রী | ২৯ মে‚ ১৯৭৭ প্রয়াণ ঘটে এই বহুল প্রতিভার মানুষটির‚ হুগলি নদীর এ পারে‚ কলকাতায় |
জীবনের শেষ দিন অবধি নিজের উপলব্ধি প্রকাশে ছিলেন দ্বিধাহীন | ১৯৭৬ সালে প্রয়াণের ঠিক আগের বছর এশিয়াটিক সোসাইটিতে বক্তব্য রাখতে গিয়ে অশীতিপর আচার্য বলেছিলেন‚ রামায়ণ মহাকব্যের উৎস বৌদ্ধ সাহিত্যের দশরথ জাতক | তাঁর এই মন্তব্যে তীব্র বিতর্ক হয় | কিন্তু স্বমত থেকে বিচ্যুত হননি ভাষাচার্য | ভাষা থেকে জ্ঞান-রস সিঞ্চন করে তাকেই আচ্ছাদিত করে রেখেছিলেন আজীবন |
~তথ্যসূত্র : আন্তর্জাল / কৃতজ্ঞতা স্বীকার রইলো