জুলাই ২৬, ২০২০: অচিন্ত্য ঘোষ-এর লেখনীতে
বিশ্বব্যাপী করোনার তাণ্ডব অব্যাহত, আর টেক্সাস শুধু আমেরিকাতেই নয়, সমস্ত বিশ্বকে ছাড়িয়ে এখন আক্রান্তের সংখ্যায় “এক নম্বরে!” কাজেই সোশ্যাল ডিস্ট্যানসিং মেনে ২০২০ সালের জুলাই মাসের সাহিত্য সভাও ভার্চুয়াল ও জুম্ ভিডিও কনফারেন্স কলে অনুষ্ঠিত হলো ২৬ তারিখ, রবিবার। জুম্ ভিডিও কনফারেন্সের বন্দোবস্ত এবং সুচারুভাবে কারিগরি সহায়তার জন্য প্রথমেই ধন্যবাদ জানানো হয় অভিষেক ব্যানার্জীকে।
সভা শুরু হয় ঠিক বিকেল সাড়ে তিনটেয় | এবারকার সভা সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন অচিন্ত্য কুমার ঘোষ ও সহযোগিতা করেন চন্দ্রা দে। সারাংশ লিপিবদ্ধ করেন অচিন্ত্য কুমার ঘোষ।
সভার শুরু হয় প্রথা সম্মতভাবে ও উপস্থিত সকলকে অভিবাদন জানিয়ে। শুরুতেই সঞ্চালক জুলাই মাস বাংলা সাহিত্যের কোন মনীষীর জন্ম মাস প্রসঙ্গের অবতারণা করলে সোমনাথ বসু বলেন তাঁর আজকের প্রবন্ধের মনীষী যিনি সেই আচার্য মহম্মদ শহীদুল্লাহ জন্মেছিলেন ১৮৮৫ সালের ১০ ই জুলাই। উদ্দালক ভরদ্বাজ বলেন শ্রী প্যারীচাঁদ মিত্র জন্মেছিলেন ১৮১৪ সালের ২২ শে জুলাই। এই সারাংশ লেখার সময় জানা গেল দ্বিজেন্দ্রলাল রায় জন্মেছিলেন ১৮৬৩ সালের ১৯ শে জুলাই। সুমিতা বসু এই দিনটির অর্থাৎ ২৬ শে জুলাই এর তাৎপর্য সম্পর্কে বলেন ১৮৫৬ সালে প্রথম বিধবা বিবাহ প্রথা আইনসম্মত ভাবে প্রচলিত হয় এই দিনটিতে। আবার এই দিনেই ১৯৯৯ সালে ভারতবর্ষ কার্গিল যুদ্ধে জয়ী হয়!
এর পর “কাজের কথা / আলোচনা, ইত্যাদি” বিষয়ক আলোচনায় আগামী মাসের সাহিত্য সভায় “২২ শে শ্রাবণ” নিয়ে যে আলেখ্যটি সুমিতা বসু পরিকল্পনা করেছেন সে বিষয়ে তিনি ও সোমা ঘোষ বক্তব্য রাখেন।
প্রবাস বন্ধু ওয়েবসাইট সম্বন্ধে আলোচনা করেন রবি ও চন্দ্রা দে, উদ্দালক ভরদ্বাজ, সুমিতা বসু ও সোমা ঘোষ। সভার অন্যান্য সভ্যদের আরও নিয়মিত ওয়েবসাইট ব্যবহার করার ও ওয়েবসাইট রক্ষণাবেক্ষণের ‘কোর টীম’ কে গুরুত্ত্বপূর্ণ কনফারেন্স কলগুলিতে অংশগ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করা হয়।
এরপর ঠিক চারটেয় শুরু হয় সভার মূল ও প্রথম পর্ব। শুরু করলেন সোমনাথ বসু তাঁর “আচার্য শহীদুল্লাহ ও বাংলা সাহিত্য” প্রবন্ধ পাঠ করে। সোমনাথদা ‘র গবেষণামূলক ও তথ্যসমৃদ্ধ প্রবন্ধগুলি আমাদের সাহিত্য সভায় সবসময় আলাদা করে নজর কাড়ে। এই প্রবন্ধটিও তার ব্যতিক্রম হয়নি ! আচার্য্য শহীদুল্লাহ শুধু প্রথম ইসলামধর্মাবলম্বী সংস্কৃত স্নাতক ই ছিলেন না, এই প্রবন্ধ থেকে কেমন করে তিনি আদালতের ওকালতি ছেড়ে বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হয়েছিলেন এবং বাংলা চর্যাপদে তাঁর অবদানের কথা আমরা জানতে পারি।
সভার বিষয়সূচি মেনে এরপর সফিক আহমেদের উপস্থাপনা স্বরচিত কবিতা ‘মুহূর্ত’ ও ‘প্রতীক্ষা।’ স্বরচিত কবিতা পাঠের আগে তিনি কবিগুরুর “প্রবাসী” কবিতার নির্বাচিত অংশ আবৃত্তি করে শোনালেন এই কবিতার বিষয়বস্তু ও আমাদের সকলের প্রবাসী জীবনের সঙ্গে সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া প্রসঙ্গে। স্বরচিত কবিতা ‘মুহূর্ত’ চির প্রবাহমান ‘সময়’ কে নিয়ে যা কোনকিছুর জন্যই প্রতীক্ষা করে থাকে না ! তাই সকল অমূল্য ‘মুহূর্ত’ কে সম্পূর্ণভাবে উপভোগ করার আর্জি এই কবিতায়। অন্যদিকে ‘প্রতীক্ষা’ কবিতাটিতে যৌবন বয়েসের প্রেমসিক্ত দুটি মন কেমন করে সামাজিক স্বীকৃতির অভাবে দুই মেরুতে প্রবাহিত ও তাদের অব্যক্ত বিরহ ব্যথাই ব্যক্ত হয়ে উঠেছে। সফিকদার কবিতা সাহিত্য সভায় ও বাংলা আধুনিক কবিতার জগতে নিজস্ব জায়গা করে নিয়েছে।
পরবর্তী উপস্থাপনা ছিল বিশ্বরুচি ও শ্যামলী মিত্রের যৌথ প্রয়াস, একটি হাস্যরসাত্মক প্রবন্ধ পাঠ। লেখাটি ‘রঙ্গ ব্যঙ্গ রসিকেষু’ নামক একটি বাংলা লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় আন্দাজ ২০১২ সালে। “রবীন্দ্রজয়ন্তী’র একাল ও সেকাল” শীর্ষক হাস্যরসাত্মক প্রবন্ধটি লিখেছিলেন সম্ভবত অভিজিৎ মজুমদার। সাহিত্য সভায় সকলের শ্রবণ-যোগ্য করার জন্য শ্যামলী লেখাটির প্রয়োজনীয় সম্পাদনা করেন। লেখাটির হাস্যরস মিত্র-দম্পতির সুবিদিত সুনিপুণ যুগ্ম কণ্ঠে অত্যন্ত উপভোগ্য ছিল !
‘ভালোবাসার বারান্দায় আছে যে দাঁড়িয়ে’ শীর্ষক পরবর্তী উপস্থাপনা সুমিতা বসুর স্বরচিত প্রবন্ধ পাঠ। সুমিতাদির নিজস্ব স্টাইলে লেখা সাহিত্য সভায় সুপরিচিত। এই লেখার মধ্যেও এক টানটান রহস্য শ্রোতাদের শেষ পর্য্যন্ত ধরে রাখে প্রবন্ধের নায়িকা কে চিনে নিতে। নায়িকা আর কেউ নন, বাংলা সাহিত্যের আকাশ থেকে সদ্য খসে পড়া নক্ষত্র শ্রীমতী নবনীতা দেবসেন। সুমিতাদির এই প্রবন্ধে শ্রীমতী নবনীতা দেবসেনের চরিত্রের নানান বৈচিত্রময় দিক সভায় উপস্থিত সকলেই উপভোগ করেন।
এর পরের উপস্থাপনা ছিল শ্যামলী মিত্রের বাংলা কথোপকথনে ‘ইয়ে’ কথার বিভিন্ন প্রয়োগ নিয়ে মজাদার রম্যরচনা পাঠ। লেখাটি সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সংগৃহীত। এই বিষয় নিয়ে লেখা ও পাঠ সাহিত্য সভায় আগে আলোচিত হলেও, শ্যামলী’র নিজস্ব স্টাইলে পাঠ সকলের উপভোগ্য ছিল।
এরপর মৃণাল চৌধুরী পাঠ করে শোনান অধুনা মহারাষ্ট্রের পুণা নিবাসী শ্রী বীরেশ্বর মিত্রের লেখা একটি ছোট ব্যর্থ প্রেমের গল্প। গল্পটি মৃণালদা পড়লেন ‘অসম্পূর্ণ ‘ নাম দিয়ে। বীরেশ্বর মিত্রের গল্প লেখার এটি প্রথম প্রয়াস। মৃণালদার থেকে আমাদের সাহিত্য সভার ওয়েবসাইটের খবর জেনে ও তার বিষয়বস্তু তে অনুপ্রাণিত হয়ে শ্রী মিত্রের এই লেখা। মৃণালদা তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ও চিরপরিচিত গল্প বলার স্টাইলে লেখাটি পড়ে শোনান। গল্পের নায়ক নিজের যৌবনের প্রথম প্রেমকে কেমনভাবে বন্ধুর একই প্রেমিকাকে প্রথম বিবাহের প্রস্তাবকে মেনে নিয়ে আত্মবলিদান দেয়, তাই দিয়ে গল্পের শুরু। গল্পের শেষে নায়িকা তার বিবাহিত জীবনের অসন্তোষে জর্জরিত হয়ে সংসারী নায়ককে প্রশ্ন করে “কেন আমায় প্রবঞ্চনা করলে” বলে। বলা বাহুল্য শ্রী মিত্রের এই প্রথম প্রয়াস অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে ! গল্প পাঠের শেষে উদ্দালক ভরদ্বাজ আবৃত্তি করে শোনালেন শ্রী তারাপদ রায়ের একই বিষয়ের ওপর লেখা কবিতা। শ্রী তারাপদ রায়ের লেখা কবিতার সঙ্গে সাহিত্য সভায় পরিচিত করে দেবার জন্য উদ্দালক কে সভার উপস্থিত সকলেই অভিবাদন জানান।
সোশ্যাল ডিস্ট্যানসিং মেনে ভার্চুয়াল ও জুম্ ভিডিও কনফারেন্স সভায় নিজের নিজের চা-কফি বানিয়ে আনার জন্য ৫ মিনিটের ছোট্ট বিরতির পর শুরু হয় সভার দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব। শুরুতেই উদ্দালক ভরদ্বাজ আবৃত্তি করে শোনালেন তাঁর বন্ধু শ্রী প্রদীপ সিংহের লেখা চারটি কবিতা, নাম যথাক্রমে ১) মেয়েমানুষ , ২) পাখি, ৩) গণিত – ৪, ও ৪) তিতি। কবিতাগুলি তাঁর ‘অনিশ্চয়তার বেড়াল’ কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া। সব কবিতাগুলি ভাবে ও কবিতার নিরিখে মৌলিক ও আধুনিক কবিতার পর্যায়ভুক্ত। উদ্দালকের সহজাত দক্ষতায় আবৃত্তিতে সব কবিতাগুলিই আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।
এরপরের উপস্থাপনা ছিল অচিন্ত্য কুমার ঘোষের স্বরচিত দুটি ‘মনসঙ্গীত’ আবৃত্তি। প্রথমটি ‘মন্দ নিয়ে মন ভাবে না, ভালো মনেই থাকি; দুঃখ সুখের ঊর্ধ্বে যেন তোমায় কাছে রাখি’ আর দ্বিতীয়টি ‘কর্ম কিছুই নয়রে ছোট যেমনই সে হোক তা, কর্ম সবই নিখুঁত হলে প্রসন্ন হন দেবতা।’ প্রথমটি পরমেশ্বরের কাছে সমস্তকিছু সমর্পণের প্রার্থনা আর দ্বিতীয়টি পরমেশ্বরের কাছে কর্মফল ত্যাগের প্রার্থনা।
সভার শেষে উদ্দালক ভরদ্বাজ গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়, সাংখ্যযোগের অনূদিত শ্লোক ১১, ১২ উচ্চারণ করে শোনান।
“কেন তবে শোক, কেন হাহুতাশ মানুষের তরে?
জ্ঞানের প্রদীপ জ্বলে নি কি তবে হৃদি অন্তরে!
নাহলে শোকের কারণ দেখে না প্রজ্ঞানী যারা
জীবনে মরণে, নশ্বর এই জীবনের ঘরে।
তুমিও ছিলে না, আমিও কখনো থাকিনি। জীবন-
রাখে নি রাজার প্রতাপও কখনো, ধরে বুকে তার।
অথচ ভুবন, শুধু ফিরে আসা, এই কলরোল
চিরদিন বাঁচা, চিরদিন ঝরে ফোটা এ কমল। “
সাংখ্যযোগের এই শ্লোকদুটিতে অন্তর্নিহিত গূঢ় ও উচ্চ কঠিন জীবনদর্শন বাংলা অনুবাদ করার দুরূহ কাজটি উদ্দালক অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করতে পেরেছেন।
বিষয়সূচি অনুযায়ী সঞ্চালক সভা শেষ করার পর জুম্ ভিডিও সভায় উপস্থিত শ্রদ্ধেয় অসিত সেন’দাকে ও শ্রদ্ধাস্পদ সুভাষ দাস’দা, ইলা-বৌদি দের আজকের সভা নিয়ে কিছু মন্তব্য করতে অনুরোধ করেন। তাঁদের সভায় উপস্থিত থাকাটি জুম্ ভিডিও কনফারেন্স-এর একটি পজিটিভ দিক। অসিতদা বললেন এই সাহিত্য সভা কে সাহিত্যের মান ও সভার নিয়ম মেনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সকল সভ্যদের দায়িত্ব। তাঁর উপস্থিতি ও সভা সম্পর্কে তাঁর সন্তোষজনক মন্তব্য সকল সভ্যের কাছে সব সময়ের অনুপ্রেরণা। সুভাষদা ও ইলা বৌদি বললেন কেমন করে তাঁরা তাঁদের জ্যেষ্ঠ পুত্র চন্দনের সহায়তায় এই জুম্ ভিডিও কনফারেন্স কলে যোগ দিতে সক্ষম হয়েছেন তার ও সভায় যোগ দিয়ে তাঁদের আনন্দ পাবার কথা। তাঁদের সকলের সকল-সুস্থতায় দীর্ঘ জীবন কামনা করি!
সকলকে সুস্থ-সুন্দর থাকার শুভেচ্ছা ও সাবধানে থাকার অনুরোধ জানিয়ে সভা শেষ হয়।