পুজোর স্মৃতি : কাশ নয়, বাঁশ
সফিক আহমেদ-এর কলমে
এখন বড় বেলায়, দুর্গাপুজোর আগমনী সংবাদ নিয়ে আসে শরতের কাশফুল বা নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মতো ভাসমান শুভ্র মেঘ, তবে আমার ছেলেবেলার দুর্গাপুজোর স্মৃতি জড়িয়ে আছে কাশ নয় বাঁশ এ ।
পার্ক সার্কাস ময়দানের পাশেই ছিল আমার বাড়ি আর স্কুল ও কাছেই। বাল্য আর কৈশোর কালের স্মৃতি ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রেখেছে পাকসার্কাস বেনিয়াপুকুর সংযুক্ত পূজা কমিটির সার্বজনীন দুর্গোৎসব আর একমাসব্যাপী মেলা।
পার্কসার্কাস এর পুজো ছিল সর্ব অর্থে সার্বজনীন। কসমোপলিটান এরিয়া তে হিন্দু মুসলমান খ্রীষ্টান সবার কাছেই দূর্গোৎসব ছিল বাৎসরিক সামাজিক উৎসব , আর সবাই মহা উৎসাহে অংশ গ্রহণ করতো এই শারদোৎসবে।
পুজোর একমাস আগে, স্কুলফেরত যেদিন চোখে পড়তো লরিভর্তি বাঁশ ফেলা হচ্ছে পার্কসার্কাস ময়দানে ,শুরু হয়ে যেত আমাদের চরম উত্তেজনা। ডেকোরেটরদের একদল তৈরী করতো মেলা প্রাঙ্গন আর আরেকদল মূল দূর্গা মণ্ডপের বিশাল বাঁশের কাঠামো, আর তারপর ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দিয়ে তৈরী হতো ছাদ, আর আমরা দিনের পর দিন তিল তিল করে গড়ে ওঠা মণ্ডপ কে অবাক বিস্ময়ে দেখতাম কিভাবে বাঁশের খাঁচাকে রঙিন কাপড় দিয়ে মুড়ে অলীক স্বপ্নপুরী করে তুলেছে খেটো ধুতি বা লুঙ্গি পরা আর কাঁধে গামছা দেয়া মজুররা। তারপর মণ্ডপের আলোকসজ্জা শেষে অধীর অপেক্ষা রমেশ পাল এর তৈরী দেবী মূর্তির আগমন আর উদ্বোধন এর জন্য।
অন্যদিকে গড়ে উঠতো মূল মণ্ডপ ঘিরে মেলা প্রাঙ্গন আর শুরু হতো আমাদের বাঁশে উঠে দোল খাওয়া। প্রায় ই তাড়া করতো মজুররা আমাদের বাঁশের ধাঁচা থেকে নামানোর জন্য। একটা থেকে নেমে আবার অন্য জায়গায় উঠতাম সে এক ভারী মজার খেলা।
একে একে আসতে শুরু হতো মেলার পসরা। বড় দোকানগুলো আসার আগেই, এসে যেত পার্ষচরিত্ররা।
চটের পর্দা লাগানো বোর্ড এ বেলুন সাঁটিয়ে এয়ারগান দিয়ে শুটিং প্রাকটিস, গ্রিপ টেস্টার মেশিন ধরে ঝুলে পরে কাঁটা ঘোরানোর চেষ্টা, বিহারি মহিলার ভুট্টা নিয়ে বসা, তালপাতা আর কাঠি দিয়ে হাতপা নাড়া পুতুল আর ঘূর্ণি , গ্যাস বেলুন, বুড়ির চুল, ঘুগনি আলুরদম ফুচকা আরো কত কি।
এদের ব্যবসার রমরমা পুজো আর মেলা শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত। তার পর এরা বিতাড়িত মেলা প্রাঙ্গন থেকে ।
এর পর এসে যেত নাগর দোলা যাতে দু জন ঝুলে পরে প্রচন্ড জোরে টেনে নামাতো নাগরদোলার চাকা আর উপর থেকে নামার সময় পেট খালি হয়ে যাওয়া আর চিৎকার, যত চিৎকার ততো বাড়তো ঘোরার গতি, আর ছিল মেরি গো রাউন্ড এ হাতি ঘোড়ার পিঠে বসে চক্কর। এসে যেত , মেলার বিভিন্ন ষ্টল এ ভারতের সব প্রদেশের শাড়ি, হ্যান্ডলুম,হ্যান্ডিক্রাফট,রান্নার যান্ত্রিক সরঞ্জাম, রুটি বানানোর মেশিন , সবজি কাটার যন্ত্র দিয়ে সমানে কেটে যেত বিভিন্ন সবজি, আর ছিল “লেলেম বাবু ছে আনা” চিৎকার করা হরেকরকম ছোটছোট জিনিসের দোকান। দোকানির হাতে একটা লম্বা ডান্ডার মাথায় একটা চামচ বাধা থাকতো।
অদ্ভুত দক্ষতায় ডাই করে রাখা ছোট ছোট জিনিসের থেকে তুলে আনতো ঠিক যেটা কিনতে চাইছে কেউ।
সবচেয়ে বড় খেলনার দোকানে এক ষণ্ডা মার্কা বিশাল গোঁফওয়ালা লোক ছিল তাকে যেই আমরা বলতাম রাবন এটার দাম কত, রে রে করে তেড়ে এসে অশ্রাব্য গালাগাল দিতো আর আমরা দিতাম দৌড়।
আর ছিল লটারির দোকান, প্রত্যেক এক ঘন্টা টিকেট বিক্রি হতো আর হাতে পাওয়া যেত একটা নম্বর , তার পর ঘুরতো চাকা , দেয়ালে ঝোলানো সাইকেল , দেয়াল ঘড়ি আর দামি দামি প্রাইজ মেলার শেষ পর্যন্ত দেয়ালেই থেকে যেত ।
প্লাষ্টিক-এর কি রিং এর একদিকে লাভ চিহ্ন আর অন্য দিকে নাম লেখানোর মেশিন নিয়ে বসতো এক পাঞ্জাবি। প্রচুর ভিড় তার দোকানে।
মেলার অন্য প্রান্তে খাবার দোকান,আজকের পোশাকি নাম ফুড কোর্ট, সবচেয়ে বেশি মনে আছে ঢাকাই পরোটা আর চাটের দোকান, থাকে থাকে সাজানো থাকতো খাবার পশরা।
ষষ্ঠী তে দেবীর উদ্বোধন হতো স্থানীয় নেতা বা কখনো ফুটবল খেলোয়াড় বা ফিল্ম ষ্টারকে দিয়ে। শুরু হয়ে যেত ঢাকে কাঠি পড়া আর কাসর ঘন্টার আওয়াজ। আসা শুরু হতো বাহারি সাজগোজে মানুষের ঢল ।
সুসজ্জিত নারী পুরুষ বাচ্চা গিজগিজ করতো, আর মাইক এ বাজতো বাংলা গান , সেতার বা সরোদ।
মেলার মাঝখানে একটা প্যাগোডা তে ছিল পুজো কমিটির অফিস, পাড়ার কাকা জ্যাঠারা ধুতি পাঞ্জাবি পরে গম্ভীর মুখে কমিটির কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতো আর ফাইফরমাশ খাটতো বাকি ভলান্টিয়ার রা।
দৈনন্দিন জীবনে এনারা হয়তো অনেকেই খুব লব্ধপ্রতিষ্ঠ নয় কিন্তু পুজোর কদিন তাদের গাম্ভীর্য আর দায়িত্বশীলতা দেখার মতো।
এখনো কানে বাজে ” এখানে একটা বাচ্চা পাওয়া গেছে, বাবার নাম দীনেশ, শেওড়াফুলি থেকে এসেছেন , যেখানেই থাকুন সত্তর পূজা কমিটির অফিস এ যোগাযোগ করুন । এই বলে বাচ্চার গলার স্বর আর কান্না ও শুনিয়ে দেওয়া হতো।
আর ক্ষনে ক্ষনে গান থামিয়ে ঘোষণা কারো স্বামী হারিয়েছে কারো বা স্ত্রী।
একটা দুল পাওয়া গেছে, মানি ব্যাগ পাওয়া গেছে , উপযুক্ত প্রমান সহযোগে পূজা কমিটির অফিস থেকে সংগ্রহ করুন।
গান ,সেতার, সরোদ, সাঁনাই আর মাঝে মাঝে হারানো প্রাপ্তি নিরুদ্দেশের ঘোষণা নিয়ে তৈরী হত অদ্ভুত আবহ।
ষষ্ঠী , সপ্তমী , অষ্টমী , নবমী দিন কে দিন বাড়তো মানুষের ভিড়।
অষ্টমী ,নবমীতে স্পেশাল ধুনুচি নাচের প্রতিযোগিতা , ধোয়া আর ছিটকে পড়া আগুনের ফুলকি দেখে মোহিত হয়ে যেতাম ।
দেখতে দেখতে দশমী, আবির খেলা আর বিসর্জনের সুর। নিয়ম করে দশমীতে বিসর্জন হতো। আজ কাল কার মতো কখনই দু একদিন বেশি রাখা হতোনা প্রতিমা।
এর পর পুজোর মণ্ডপের হতো রূপান্তর, ঘিরে দেওয়া হতো করোগেটেড টিনের বেড়া দিয়ে।
শুরু হত ২১ দিন ব্যাপী বিচিত্রা অনুষ্ঠান , নাটকের প্রতিযোগিতা আর যাত্রা। ডেইলি বা season টিকেট কিনতে হত।
আমরা পূজা কমিটির হত্তাকর্তা কাকা, জ্যাঠাদের দেওয়া পাস এর মুখ চেয়ে বসে থাকতাম আর ভরসা ছিল টিনের বেড়ার ফুটোতে চোখ রেখে দেখা।
যাত্রা দেখতে দেখতে লোম খাড়া হয়ে যেত , এখন বুঝি সেটাকে goosebump বলে।
এক মাস পর বেজে উঠতো বিদায়ের সুর ।
খুলতে শুরু হত টিনের বেড়া , খোলা হোত মণ্ডপের কাপড়, বেরিয়ে আসতো বাঁশের কাঠামো , মেলার দোকান এক এক করে গুটিয়ে তুলতো তাদের পশরা। কয়েকটা দোকান শেষ পর্যন্ত পরে থাকতো ব্যবসার লোভে।
শেষ দোকান তুলতো রাবন।
আমরা অবশ্যই শেষ দিনে সমস্বরে রাবন রাবন বলে তাকে উত্তক্ত করতাম তবে তখন আর তেড়ে আসতো না আর গালাগালি ও দিতোনা। তার ও মনে বাজছে বিদায়ের সুর।
এক মাসের স্বপ্নপুরী আর সুসজ্জিত মেলা প্রাঙ্গন বদলে যেত এবড়োখেবড়ো মাঠে আর ডাই করা স্তূপাকৃতি বাঁশ এ।
লরি এসে তুলে নিয়ে যেত বাঁশ আর আমাদের প্রতীক্ষা হত শুরু,
আসছে বছর কবে পড়বে বাঁশ।
আজ বহু বছর দেশ ছাড়া , আমেরিকা, কানাডা বা মধ্য প্রাচ্যের বাঙালিদের দূর্গাপূজা আর শারোদোৎসবে যোগ দিয়েছি।
কোথাও কমিউনিটি হল এ পুজো আর অনুষ্ঠান, কোথাও বা সাড়ম্বরে মন্দিরে পুজো আর সুসজ্জিত অডিটোরিয়ামে নাটক, গানের আসর , জাকজমকের অভাব নেই তবুও মনের কোনে খুঁজে ফিরি ছোটবেলার পুজো, পুজোর মেলা আর বাঁশের মন্ডপ।