২২ শে শ্রাবণ
প্রবাসবন্ধুর পক্ষ থেকে কবি প্রণাম : ছবি ও লেখা আন্তর্জাল থেকে নেওয়া, আন্তরিক কৃতজ্ঞতা রইল।
৬ই আগস্ট,১৯৪১, শ্রাবণ পূর্ণিমার রাত। চারিদিকে চাঁদের আলোয় থই থই করছে। প্রতিমাদেবী বারান্দায় দাঁড়িয়ে টের পাচ্ছেন কোমল জোছনায় কার যেন কান্না লেগে আছে। উঠানে নিঝুম হয়ে আছে ডাক্তারের গাড়ি। বাবামশায়ের ঘরে আলো জ্বলছে। লোকজন পা-টিপে টিপে যাতায়াত করছে। খবর আসতে পারে যখন-তখন রবীন্দ্রনাথ চলে গিয়েছেন। মর্ত্যলোকের লীলা সাঙ্গ হয়েছে তাঁর। ভরা শ্রাবণ আজ বৃষ্টি লুকিয়েছে। মানুষের চোখের জলে তাই বুঝি মাটি ভিজবে এবার।
একা একা অঝোরে কাঁদছিলেন প্রতিমা দেবী। একসময় সুধাকান্ত ও রাণী চন্দ এসে তাঁকে বললেন, “চলুন একবার”।
রবীন্দ্রনাথের ঘরের দিকে ধীরে ধীরে পা বাড়ালেন প্রতিমা। বাবামশায়ের কানের কাছে গিয়ে ডাকলেন একবার, “বাবামশাই, আমি………” আর বলতে পারলেন না। বাবামশাইও কোন উওর দিলেন না আর।
বাবামশায়ের পাশে নিকট আত্মীয়েরা ধীরে ধীরে জড়ো হচ্ছেন। রাত বারোটার পরেই কবি অনন্তের দিকে যাত্রা শুরু করলেন। রাণী চন্দ গুরুদেবের পায়ের কাছে বসে দেখলেন, রবীন্দ্রনাথের পূবমুখী শিয়রের ওপাশের আকাশে শান্ত, স্নিগ্ধ পূর্ণিমার চাঁদ।
জোছনার চন্দন ঝরে পড়ছে বিশ্বকবির অনন্তলোকগামী দুই ডানায়, ওই কবি ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছেন। রাণী চন্দ থর থর করে কাঁপতে লাগলেন। গান ভেসে আসছে…….
“কে যায় অমৃতধাম যাত্রী……..”
রাত দুটোয় রাণী মহলানবিশ ফোন পেলেন, ৭ই আগস্ট, ১৯৪১ আজ বাংলার ২২শে শ্রাবণ, ভোর চারটে থেকে নিকট আত্মীয়, বন্ধু-পরিজন,প্রিয়জন দলে দলে আসতে লাগলেন। ঠাকুর বাড়ির বাইরে সকাল থেকে কবির অগণিত ভক্তের ভিড়, তারা সব্বাই একটিবারের জন্যে তাঁকে দেখতে চান, তাদের প্রবল জনস্রোতে ঠাকুর বাড়ির মূল প্রবেশ দ্বার ভেঙে পড়েছে।
সকাল সাতটায় রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় কবির শেষশয্যার পাশে বসে উপাসনা করলেন। মেয়েরা গাইছে কবির রচিত ব্রহ্মসংগীত। ন’টা থেকে অক্সিজেন দেওয়া শুরু হলো। গুরুদেবের পায়ে প্রতিমাদেবী অঞ্জলি ভরে চাঁপাফুল দিয়ে গেলেন। গুরুদেবের পায়ের হাত রেখে রাণীরা টের পেলেন ক্রমশ উষ্ণতা কমে আসছে। দুপুর ১২:১০ মিনিটে কবি সম্পূর্ণ চলে গেলেন।
নন্দলাল বসু গুরুদেবের শেষযাত্রার পালঙ্ক নির্মাণ করলেন, সহযোগীকে আবেগাপ্লুত ধরা গলায় বললেন, যা আজ রাজার রাজা নগর পরিক্রমা করে চিরবিদায় নেবেন, বেনারসি চাদর নিয়ে আয়, লাল বেনারসি কাপড়ে সোনালী বুটি দেওয়া চাদর পাতা হল পালঙ্কে। সহস্র জুঁই, বেলের মালায় ঢাকা পড়ল সেই রাজ পালঙ্ক। গুরুদেবকে সাদা বেনারসি জোড় পোরানো হল, সাথে গরদের পাঞ্জাবি, কোঁচানো ধুতি, গলায় রজনীগন্ধার গোড়ের মালা, কপালে চন্দন। তাঁর চারপাশে শতসহস্র শ্বেতপদ্ম ও রজনীগন্ধা। তাঁর হাতদুটি বুকের কাছে ছিল, সেখানে দেওয়া হল একটি শ্বেতপদ্ম কোরক। ঠিক যেন ঈশ্বর শুয়ে রয়েছেন নিদ্রামগ্ন হয়ে। শত সহস্র মানুষের কাঁধে চেপে শুরু হল অন্তিম যাত্রা……….শ্রাবণের শরীরে হাত রাখল চির বিষাদ। (সাবর্ণ)