“এ আমার গুরুদক্ষিণা …………”
শ্রাবণী রায় আকিলার কলমে
আজ একটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে এবং আমার ছোটবেলায় বা পরবর্তী জীবনে তার প্রভাব নিয়ে কিছু লেখার বড় ইচ্ছে হল। এখন কথা হচ্ছে ,কি -ই বা আমার জীবন, আর তাতে কিসেরই বা এত প্রভাব ! জেনেই বা কারোর লাভ কি, না জানলেই বা ক্ষতি কি ! তবু দেওয়াল যখন নিজের এবং আনসলিসিটেড বকবক করায় যখন আমার অনীহা নেই ,তখন এই গুরু পূর্ণিমার মত বিশেষ দিনে ,দুরুদুরু বক্ষে লিখেই ফেলি।
ভারতীভবন ….আমার ছোটবেলার শহরের সবথেকে প্রেস্টিজিয়াস সাংস্কৃতিক মঞ্চ। চলত সভ্যদের মেম্বারশিপের টাকায় এবং মূলত ইস্কোর পৃষ্ঠপোষকতায়। এবাদে মূলধন ছিল শহরের বেশ কিছু শিল্প,সাহিত্যপ্রেমী মানুষের ভালোবাসা ও পরিশ্রম। আমার জ্ঞান হওয়া থেকে কলেজ জীবনের শেষ পর্যন্ত, আমি বার্নপুর ছেড়ে চলে আসা পর্যন্ত, সত্তরের শেষ থেকে নব্বই দশকের শেষ পর্যন্ত সময়ের প্রেক্ষাপটে এই ভারতীভবনই আমার স্মৃতিতে সব থেকে বেশি উজ্জ্বল। কেন ? কারণ কিছু নক্ষত্রের মত মানুষ !
মঞ্চে সাদা পাজামা পাঞ্জাবীতে সলিল চৌধুরী ,পাশে সবিতা চৌধুরী, ক্লাস সিক্সে পড়া অন্তরা চৌধুরী ,তার বোন সঞ্চারী। সঙ্গে বাদ্যযন্ত্রে আরো কয়েকজন। মা যখন মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে প্রকৃত অর্থে সুরের জাদুতে শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছেন ,তখন ‘কি-বোর্ডে’ নীরব ঝড় তোলার ফাঁকে ফাঁকে সলিল চৌধুরী বলে চলেছেন কিশোর কুমার ,রাজ্ কাপুর,লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা তাঁর সংগীত জীবনের টুকরো টুকরো গল্প, IPTA র গল্প। অন্তরা তার লতামাসির গাওয়া প্রিয় গান ‘রজনীগন্ধা ফুল তুম্হারে ‘ গাইলো একা ! সেই শুনে মায়ের কানে কানে বলছি ” মা,লতা মঙ্গেশকরকে মাসি বলছে !!!” ঘন্টা তিনেক পেরিয়ে গেছে মুগ্ধতায় ।।তবু পাগলের মতো দর্শক শ্রোতাদের অনুরোধ ধেয়ে আসছে। অনুষ্ঠান শেষে উঠে পড়লাম সটান মঞ্চে,বাধা নেই, মারামারি নেই, ফটো তোলা নেই। শুধু কিছু অটোগ্রাফের আবদার। উত্তরে: ” কোন ক্লাসে পড়ো ?” বলে স্নেহশীল হাসি। মান্না দে আসতেন ঘন ঘন। ভারতীভবনের মঞ্চ তার বিশেষ পছন্দের ছিল । গাইতে গাইতে কখনো মাথার টুপিটা ছুঁড়ে দিতেন,কখনো রাত বারোটায় বলতেন, “আপনাদের খিদে ঘুম কিছু নেই নাকি? এ তো আজ ছাড়া পাবো বলে মনে হচ্ছে না ! ” বড় একা লাগে – গান ধরার ফাঁকে আবার একটু ‘উত্তমবাবু’র গল্প। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় একটা হারমোনিয়াম নিয়ে অবলীলায় গেয়ে চলেছেন ” রানার ছুটেছে ….” কাঁধ থেকে শাল খসে গেলো। যত্ন সহকারে তুলে দিলেন পাশে বসা স্ত্রী বেলা মুখার্জি ! সৌমিত্র চ্যাটার্জি বিরক্ত কবিতা পড়াকালীন এতো ক্যামেরা,ফ্ল্যাশলাইটের ঝলকানি দেখে ! দর্শক কবিতা শুনতে এসেছেন না ফিল্মষ্টার দেখতে ? একাধিকবার বারণ করা সত্ত্বেও বিশেষ কাজ না হওয়ায় একটানে চশমা খুলে বিরক্তিতে মুখ লাল করে বললেন, “আবৃত্তিকারকে এত বড় করে দেখলে কবিতাকে অসম্মান করা হয় ! ” ভাবি এখন মঞ্চে শিল্পীদের মুখের সামনে গিয়ে দর্শকদের তুমুল নাচ দেখলে কি বলতেন !!
একবার অপর্ণা সেন শ্রুতিনাটক করাকালীন বোধহয় দর্শকাসনের কোথাও আগুন লেগেছে বলে মনে হল। হুড়োহুড়ি পড়ে গেলো। অপর্ণা সেন পালাতে পারতেন মুহূর্তে। পালালেন না। শ্রুতিনাটক থামিয়ে সুশিক্ষিত শিল্পীর মত একনাগাড়ে মাইকে অনুরোধ করে গেলেন ” আপনারা বয়স্কদের আগে বেরোতে দিন, সামনে বাচ্চা নিয়ে কোনো মা থাকলে দৌড়ে মঞ্চে এখানে উঠে আসুন , এখান থেকেও বাইরে বেরোনোর দরজা আছে। ” একবার দেখলাম একজন শিল্পী অনেকগুলো তবলা চারদিকে নিয়ে বাজাচ্ছেন। সঙ্গে বেশ অল্পবয়সি একটি ছেলে। দুজনার সে কি সুরমূর্ছনা তবলায়। শুনলাম তাঁরা নাকি সম্পর্কে বাবা ছেলে। নাম শঙ্কর ঘোষ ও বিক্রম ঘোষ। আর একবার দেখলাম ঝাঁকড়া চুলওয়ালা আর এক জন এলেন । তিনি তবলা বাজাচ্ছেন ,হাতই দেখতে পাচ্ছি না। পরে তাকে টিভিতে একটা চায়ের বিজ্ঞাপনে দেখে কি আনন্দ, উত্তেজনা ! আর একবার দুজন এলেন , একজন সন্তুর বাজান,একজন বাঁশি। কি অপূর্ব যে লাগল শুনতে কয়েকঘন্টা । শুনলাম তাঁরা নাকি সদ্যমুক্তি প্রাপ্ত ‘সিলসিলা’ বলে একটা কি হিন্দি মুভিতে সুর করেছেন। চাদ্দিকে একেবারে নাকি হৈহৈ পড়ে গেছে ! একবার মঞ্চে সারাক্ষন প্রায় চোখ বুজে মগ্ন হয়ে সরোদ বাজিয়ে দর্শকশ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখলেন অসাধারণ দেবতার মত দেখতে এক শিল্পী। ইন্দিরা গান্ধী সবে নিহত হয়েছেন তখন। বাজালেন বোধহয় তাঁর স্মৃতির উদেশ্যে শিল্পীর নিজের সৃষ্ট রাগ প্রিয়দর্শিনী ! কি ভদ্র সুন্দর করে কথা বলে অটোগ্রাফ দিলেন কালো কাশ্মীরি কাজ করা শালের ভেতর থেকে গোলাপি রঙের হাত বাড়িয়ে । সঙ্গে তাঁর স্ত্রী শুভলক্ষী। শুনলাম তিনি নিজে একজন নৃত্যশিল্পী। নৃত্যশিল্পী বলতে মনে পড়ল ,কখনো একসঙ্গে ,কখনো আলাদা আলাদা আমন্ত্রণে ভারতীভবনের মঞ্চে অমলাশঙ্কর, তনুশ্রীশঙ্কর, মমতাশঙ্কর এসেছেন।
অসামান্য নাচের অনুষ্ঠানের পরে দিব্যি মঞ্চ সংলগ্ন মেলায় ঘুরে ঘুরে ভীড়ে মিশে কিনেছেন নানা প্রদেশের আচার, বেডকভার। কখনো নাচ ছাড়া শুধুই বাজনায় মঞ্চ মাতিয়ে রেখেছেন আনন্দশঙ্কর। ট্রুপের শিল্পীদের তদারকিতে চন্দ্রোদয় ঘোষ ।কখনো আরতি মুখার্জি “এবার একটা আপনাদের সকলের পছন্দের গান শোনাই ” বলে ধরছেন ” এই মোম জোছনায় ” তো কখনো নির্মলা মিশ্র ” ও তোতা পাখি রে !” রবীন্দ্রসংগীত শোনাতে আসতেন কণিকা বন্দোপাধ্যায়, মায়া সেন, সুচিত্রা মিত্র । সুমিত্রা সেনের পাশে বসে প্রথম গাইতে দেখেছিলাম টিয়া রঙের শাড়ি পরে খুব কম বয়েসি ইন্দ্রানী সেনকে। প্রথমবার অনুপ জালোটা এলেন, সে প্রায় দমই নেন না গাইতে গিয়ে ! আমার শুনতে শুনতে দমবন্ধ হওয়ার যোগাড়। তেমন ভালো লাগল না। দর্শক পাগল হওয়া কাকে বলে স্বচক্ষে দেখেছিলাম যখন ভূপেন হাজারিকা তাঁর মাদকতাময় কণ্ঠে হারমোনিয়ামে হাত দিয়ে রাজকীয় অথচ নম্র উচ্চারণে ধরেছিলেন ” বিস্তীর্ন দুপাড়ে ……!” বাবার দুচোখ দেখলাম একটু পরেই জলে ভরা !
প্রতিবছর বঙ্গসংস্কৃতি সম্মেলনের দিন সাতেক পড়াশোনা একেবারে শিকেয়! হোমওয়ার্ক হবে কি হবে না তা নিয়ে সে কদিন বিশেষ কোনো চিন্তা নেই। প্রয়োজনে পরের দিন স্কুল কামাই। প্রতিটা সারারাতব্যাপী অনুষ্ঠানে বাবা বাড়ী থেকে কফি করে নিয়ে যেত। একটু একটু করে বাইরে আলো ফুটছে, ভীমসেন যোশী বা পন্ডিত যশরাজ অনুষ্ঠান শেষ করছেন ভোরের কোনো রাগ দিয়ে। চোখ খুলে রেখেছি তখনো। বাবা কফি ঢেলে দিয়েছে হাতে ধরা কাপে। দেখেছি কিভাবে নাটকে মঞ্চ কাঁপিয়েছেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, অজিতেশ বন্দোপাধ্যায় । যোগেশ দত্তর মূকাভিনয়ও বারবার দেখতে যেতাম। রবি ঘোষকে নাটক শেষে অত সিরিয়াস আর গম্ভীর দেখে ভয় পেয়েছিলাম বেশ। রাত দুটোর সময় লুঙ্গি পরে, চাদর গায়ে একটা নিমের কাঠি হাতে নিয়ে দাঁত মাজছিলেন কেন দেখে অবাকও হয়েছিলাম খুব ! ভীষণ ভালো লাগতো মা ও মেয়ে মঞ্জুশ্রী চাকী সরকার ও রঞ্জাবতী চাকী সরকারের নাচ দেখতে,পূর্ণিমা ঘোষের মনিপুরী নৃত্য, অমিতা দত্তের কত্থক নাচের অনুষ্ঠান ঘুরেফিরে দেখতে। মুক্ত মঞ্চের অনুষ্ঠান শুরু হতো ছৌ নাচ বা সাঁওতাল নৃত্য দিয়ে। তারপর কোনোদিন রুমা গুহঠাকুরতার কয়ারের গান, কোনোদিন উদ্দাত্ত কণ্ঠের সবিতাব্রত দত্ত, কোনদিন মেলা থেকে বৌ এনে দেওয়ার আকুতি কণ্ঠে নিয়ে অংশুমান রায়। লোকগীতি নিয়ে অমর পাল বা নির্মলেন্দু চৌধুরী।
ফি বছর শীতের সন্ধ্যেয় পুরাতনী গানে,টপ্পায় বৈঠকী আমেজ ছড়াতেন রামকুমার চটোপাধ্যায়। আশেপাশের বয়স্ক মানুষদের মধ্যে বসে দুলে দুলে বেশ শুনতাম ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়ের কীর্তনাঙ্গের গানও। ভারতীভবনে প্রায়দিনই শীত বসন্তের সকাল শুরু হতো ধুতি পাঞ্জাবী পরিহিত, শাল গায়ের সাহিত্যিক সমাবেশে। চোখ কচ্লেও বিশ্বাস করতে পারতাম না কাদের দেখছি,কাদের কথা শুনছি। নারায়ণ সান্যাল,গঙ্গোপাধ্যায়, মাঝে মাঝে একটু এদিক ওদিক টলে যাওয়া সুনীল,শক্তি ! সঙ্গে সমরেশ বসু,মজুমদার,কবিতা সিংহ ,শীর্ষেন্দু থেকে একেবারে মূলক রাজ্ আনন্দ। তুষারকান্তি ঘোষের বক্তৃতা আরো ঘন্টা খানেক হলে মন্দ হতো না বলে মনে হয়েছিল। শ্রুতিনাটক ও কবিতার ভান্ডার নিয়ে আসতেন জগন্নাথ বসু, উর্মিমালা বসু। কর্ণ-কুন্তী সংবাদে মঞ্চ মাতানোর পরের দিন ভারতীভবনেরই ব্যবস্থাপনায় আমাদের ছোটদের নিয়ে ধ্যৈর্য ধরে আবৃত্তির ওয়ার্কশপ করিয়েছিলেন পার্থ ঘোষ, গৌরী ঘোষ, কখনও প্রদীপ ঘোষ।
ভারতীভবনের অন্য প্রাঙ্গনে ঘুরে ঘুরে প্রতি বছর দেখতাম ছবির প্রদর্শনী। আসতেন পরিতোষ সেন, যোগেন চৌধুরী। দুপুরে লাইন করে স্কুল থেকে যেতাম পুতুল নাচ বা ছোটদের সিনেমা দেখতে। নানা প্রোগ্রাম ,সভা দেখা ছাড়াও ,ভারতী ভবন মানেই ছিল রবিবার তার কোনো এক ঘরের মেঝেতে রং ছড়িয়ে অনেক বাচ্চার সাথে ছবি আঁকা, কখনও রাগ ভূপালীর সরগম গাওয়া,ফুলের মালা দেওয়া বিশাল রবীন্দ্রনাথের ছবির সামনে বসে প্রজেক্টরে কলকাতা থেকে নিয়ে আসা কোনো বিখ্যাত ব্যক্তিত্বকে নিয়ে শিক্ষামূলক ডকুমেন্টরি দেখা ,লাইব্রেরিতে সময় কাটানো আর সবথেকে বেশি ছিল ভারতীভবনের সব প্রাণপুরুষ ,ইস্কোর জ্যেঠু কাকুদের অপার স্নেহ। ছোটবেলায় ভারতীভবনেই ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে দেখেছি দেশ বিদেশের বেশ কিছু নাম করা সিনেমা।
ধীরে ধীরে হারমোনিয়ামের বদলে গীটার হাতে আসতে শুরু করলেন অঞ্জন দত্ত, নচিকেতা, সুমন। অনেকটা বড় হয়ে গেছি তখন। জীবনমুখী মরণমুখী বিতর্কে কান দিচ্ছি না। খুব ভালো লাগছে তাদের গান, জিন্স,গীটার ,অন্যরকম সুর,উপস্থাপনা ….কিন্তু সময় এলো আমাদের শহর ছাড়ার …
কয়েক বছর আগে এমনিই পুরোনো শহর ,অলিগলি ঘুরতে গিয়ে এক ফাঁকা সকালে গেছিলাম ভারতীভবনেও। সেই মঞ্চটা প্রায় একইরকম আছে দেখলাম । অনুষ্ঠান কতটা হয় জানি না। তাদের কোনো সোশ্যাল মিডিয়ায় অথেন্টিক পেজ আছে কিনা জানি না। কেউ লাইক কমেন্ট করতে বলে মেসেঞ্জারে অনুরোধ বা নেমন্তন্ন করেনি। স্বেচ্ছায় মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করতে নিজেরই মন চেয়েছিলো। করেছিলামও। ভারতীভবন ….কোনও এক ব্যক্তি নয় ,একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ,যাকে মনে মনে আমি গুরুর মর্যাদা দিই ,যার স্মৃতি যেকোনো মন খারাপে আজও আমায় পূর্ণিমার মতোই আলো দেয় !
লেখার শিরোনাম বড় ক্লিশে,তবু এই মুহূর্তে এটাই যথাযথ মনে হল ..
(ছবিটি আন্তর্জাল থেকে নেওয়া, কৃতজ্ঞতা রইলো।)