মধ্যরাতের রাজা
অমৃতা মুখার্জীর কলমে —
লস এঞ্জেলস এর এক হসপিটালে সেদিন অদ্ভুত এক পরিস্থিতি । সার্জেন রুগীকে দেখতে এসেছেন আঞ্জিওপ্লাস্টি করবেন । রুগীর হার্টের ধমণীতে বড়সড় একটি রক্তপিন্ড বসে চা-শিঙ্গারা খাচ্ছে।
রুগী হাত নেড়ে হেসে উড়িয়ে দিল। “আরে পাগল না পেটখারাপ? নিকুচি করেছে প্লাস্টির ! আমার বিয়ে তো পরশু, ওসব পরে হবে খন।”
সার্জেনের পিলে চমকানোর পূর্বাবস্থা। কনে মিষ্টি হেসে বললেন “আমি কিন্তু সাত নম্বর বউ, এর আগে ছ’বার ডিভোর্স হয়েছে উনার। হার্টের উপর যেন চাপ টাপ পড়বেনা তো?
“চাপ?
সার্জেন তখন মানে মানে বাপ বলে কেটে পড়তে পারলে বাঁচেন।
দুগগা, হনুমান, আল্লা, যীশু সব্বাই কে গড় করে হাতে ছুরি তুলে নিলেন। সার্জারির তিন-দিন পর রুগী দিব্যি সেজেগুজে বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়লেন। কনে শ্যারন পরে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, “সার্জেনকে ধন্যবাদ, একমাত্র এই বিয়েটাই দশ বছরের বেশি টিকে গেল।”
রুগীর নাম ? কে আবার ? ল্যারি কিং। তিনি ইতিহাসের তোয়াক্কা না করে নিজেই নিজের ইতিহাস লিখে ফেলতেন অহরহ। ব্রুকলীনের প্রায় হাঘরে গরীব রাশিয়ান ইহুদীর সন্তান। মা রাশিয়ান, বাবা অস্ট্রীয়ান ভাগ্যের সন্ধানে আমেরিকায়। মাত্র ন’বছরে বাবা মারা গেলেন। কোনরকমে হাইস্কুল পাশ করে পেটের ধান্দায় চলে এলেন মায়ামিতে। টক শো ষ্টুডিওতে মাসে ৫০ ডলারের ফাইফরমাশ খাটার কাজ। কাজটি যাই করুন না কেন, কান খাড়া করে ব্রডকাস্ট শোনেন। একদিন সুযোগ এল। হোস্ট আসতে পারেন নি। ঝাঁটা ফেলে বসে পড়লেন মাইকের সামনে।
তারপরের ইতিহাস টা ধূমকেতুর আবির্ভাব হেন। সারা জীবনে তিরিশ হাজার লোককে ইন্টারভিউ করে গিনেস বুক অফ রেকর্ডে নাম উঠেছে তার। এই তালিকায় আছে, প্রেসিডেন্ট নিক্সন, ক্লিন্টন, বুশ, ওবামা যেমন, তেমনি ওপরা, জুলিয়া রবার্ট, মার্লন ব্রান্ডো, মেরিল স্ট্রীপ, জন ট্রাভোল্টা, হিউ গ্রান্ট, প্রিন্সেস ডায়ানা। তার শো মানেই রাত জেগে ঠায় বসে থাকা নতুন কোন চমকের আশায়, লাল রঙের সাস্পেন্ডার আর ব্লু জামা পরে ল্যারি প্রাক্টিকালি যা করবেন সেটাই খবর। সে মার্লন ব্রান্ডকে চকাস করে ঠোঁটে চুমু হোক, বা জ্যান্ত সাপ মুঠোয় ধরে ভেল্কি বাজি, অথবা কারো নকল পা খুলে সোজা টেবিলে রাখাই হোক। তিনি অনবদ্য ভঙ্গিমায় পেশ করবেন আর আপনি নিজের অজান্তে তালি মারবেন।
তার যেটা সবথেকে বড় গুণ যে তিনি প্রচন্ড সপ্রতিভ, জিন্দেগীতে থতমত খেয়ে তো-তো করতে কেউ তাকে দেখেনি। তিনি চোখ মটকে বলবেন ” ইয়ার্কী পেয়েছ? ভুলে যেও না আমি ব্রুকলীনের ইহুদীর বাচ্চা, নো চালাকী”। তার প্রথম বস তার খটমট লাস্ট নেম দেখে নাক সিঁটকোলে তিনি ফস করে মায়ামি লিকার কোম্পানীর সাইন বোর্ড দেখে বলে দিলেন ” কাল থেকে আমার নাম ল্যারি কিং, এবার শান্তি?” জগৎ বিখ্যাত হয়ে গেলেন সেই নামে। রেস্টোরান্টে কাজ দিয়েছো ? প্রথম ইনটারভিউ করলেন সার্ভারকে। এত মজাদার আর সৎ প্রতিবেদন, বিখ্যাত গায়ক বব দারিন পর্যন্ত মুগ্ধ হয়ে গেলেন। নিজে এসে ইন্টারভিউ দিলেন পরদিন। ব্লক বাস্টার হয়ে গেল।
টানা পঁচিশ বছর CNN এর মত চ্যানেলে ল্যারি কিং লাইভ করেছেন। কেউ ছুঁতে পারেনি তার জনপ্রিয়তা। আন্ডারসন কুপারকে হাতে ধরে শিখিয়েছেন তিনি। ও জে সিম্পসনের ভয়াবহ ট্রায়ালকে সারা পৃথিবীর সামনে তুলে ধরেছন অবিশ্বাস্য দক্ষতায়। কখনো পক্ষপাতিত্ব করেন নি। তিনি সাংবাদিক, তিনি জনগোষ্ঠীর চশমা । তার নিজস্ব মতামত কারো ঘাড়ে কেন চাপাবেন? বিখ্যাত লেখকদের যখন ইন্টারভিউ নিতেন, কখনো তাদের বই আগে পড়তেন না, বলতেন “তাহলে আমার আর সাধারণ মানুষের তফাতটা কি? অনেকেই পড়েনি? কিন্তু পড়তে চায়, আমি তাদের মত সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করব। আমি কত জানি সে কায়দা দেখানোর প্লাটফর্ম এটা নয়।”
তার প্রশ্ন গুলো খোলা ল্যাজের, ওপেন এনডেড, যা খুশি বল। কোন ন্যাকামি, ঢাকা-চাপার গল্প নেই। যা ইচ্ছা হড়হড় করে বল দিকি চাঁদু, ল্যারি ঘাপটি মেরে বসে আছেন কানটি খোলা আছে। কাউকে ছোট করবেন না। সে জেলের খুনী আসামী হোক আর মণিকা লিউন্সকি হোক। সেও তো বেচারী একটা বোকা মেয়েমানুষ, মিডিয়ার খপ্পর আর ওদিকে প্রেসিডেন্ট এর প্রেম ?
চাপ টা কি কম নাকি? তার জীবনটা যে তছনছ হোল ? সেটা?
কে বুঝবে? সবাই তো দোষ দিয়ে খালাস। ল্যারি বুঝলেন। সান্ত্বনার প্রলেপ দিলেন। শুধু ই অশ্লীল যৌণতা নয়, প্রেম ছিল, ওয়াল্ট হুইটম্যানের লীভস অব গ্রাস ছিল, কবিতা ছিল। সবাই মানুষ, প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে। কারো দোষ টাই বড় নয়। বুকের চিতায় জল দিলেন তিনি।
কোনদিন কলেজে যাননি। কিন্তু তার কৌতূহল তাকে সব শিখিয়েছে। হার্টের অসুখ হলেও তার উপর দারুন বই লিখে ফেললেন। বেস্ট সেলার হয়ে গেল। মেয়ে ঘ্যান ঘ্যন করছে, দাঁড়াতো দেখছি। লিখে ফেললেন ড্যাডি আন্ড ডটার। পিবডি পুরস্কার, এমি, ACE প্রাইজ সব পেয়েছেন। তার শোতে এসে রস পেরট আল গোরের সঙ্গে বাজি রেখে আমেরিকাকে কিনে নেবার দান দিলেন। সেই শো ইতিহাস হয়ে গেল। তিনি ছিলেন সেই মিদাসের মত— যা ছুঁতেন সোনা হয়ে যেত।
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কাজ করেছেন। পলিটিকিং উইথ ল্যারি। ক্যন্সার তাকে কাবু করতে পারেনি। লড়ে গেছেন বীরের মত। সাস্পেন্ডার পরে ষ্টুডিও তে হাজির তিনি। জীবন লেবু দিলে, তিনি হাসতে হাসতে লেমনেড বানাতে জানতেন। শেষ টায় কোভিড এসে কেড়ে নিল তাকে। তাতে কি? ল্যারি আছেন সবার হৃদয়ে। লাল সাস্পেন্ডার আর ব্লু জামা পরে ব্যাকপ্যাক নিয়ে বেড়িয়ে পড়লেন মহাযাত্রায়, কেপ টাউনের সমুদ্র পার দিয়ে যেতে যেতে দেখা হয়ে গেল সেই লোকটার সাথে। ভারি শান্ত হাসি মুখ। নেলসন ম্যান্ডেলা। হাত ধরলেন দুই বন্ধু।
“এবার প্ল্যান টা একটু অন্যরকম, এবার আমি প্রশ্ন করব , তুমি উত্তর দেবে।” ল্যারি এক গাল হেসে রাজী। “চল হিমালয়ের দিকটা একবার যাবে নাকি? ভারতবর্ষ শুনেছি একটা আশ্চর্য দেশ। স্বর্গের সিঁড়ি নাকি ওখান থেকেই শুরু। চল বেড়িয়ে পড়ি মহাযাত্রায়।”
♥♥♥♥♥♥♥♥♥♥
©Amrita Mukherjee
আপনাদের মতামত জানতে পারলে ভাল লাগবে