নভেম্বর ২২, ২০২০ : সুমিতা বসুর লেখনীতে
গত কয়েক মাস যাবৎ করোনার অকল্যাণে বা কল্যাণে প্রবাসবন্ধুর সভা বসছে পুরোপুরি ভার্চুয়াল। এর ফলে নিবিড় করমর্দন করতে না পারলেও, ‘দূরকে করেছ নিকট, বন্ধু’ এই ডাকে আমরা অনেককেই পেলাম কাছে—নভেম্বরী বৈঠকে। এ মাসের সভার আয়োজন ছিল আমাদের (সোমনাথ ও সুমিতা বসু ) দায়িত্বে। বিশেষ অনুরোধে নীতা শেঠকর অপূর্ব এই সঞ্চালনার ভার কাঁধে তুলে নিয়ে, সম্পূর্ণ সভাটি সুষ্ঠভাবে পরিচালনা করে অকুন্ঠ প্রশংসা পেয়েছে।
সভা বিষয়ে বিশদ লেখার আগে, কয়েকটা ধন্যবাদ জানিয়ে নিই। অভিষেকের উদ্যোগে এই zoom দেখাশোনার আসরগুলি নিখুঁত ভাবে চলছে। রবি ও চন্দ্রার নিয়মিত ও সুভাবিত মাসিক সভা আয়োজন প্রশংসার দাবী রাখে। ভার্চুয়াল হওয়ার দরুণ অস্টিন থেকে অসিতদা, বস্টন থেকে দুজন অতিথি (সুমিত নাগ ও গৌরী দত্ত) অনায়াসে যোগ দিতে পারলেন, এটাই কোরোনার কারণে সুবিধার দিক।
প্রথমেই সদ্য প্রকাশিত শারদীয়া পত্রিকা নিয়ে মালবিকাদি (চ্যাটার্জী) খুবই উৎসাহব্যঞ্জক কথা বললেন, সত্যি পত্রিকাটি দেখতে যেমন ঝলমলে আর লেখাও তেমনি সমৃদ্ধ, সভ্য সভ্যা ছাড়াও অনেক লেখাই এসেছে বাইরে থেকে। সুচারু সম্পাদনা ও পরিছন্ন পরিবেশনার জন্য মালবিকাদি ও চন্দ্রা ( দে) কে সভাপক্ষ থেকে অজস্র ধন্যবাদ। পত্রিকাটি ওয়েবসাইট এ আছে, সকলের পড়ার জন্য।
আমাদের ওয়েবসাইট-এ ব্লগ লেখার জন্য সকলকে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে, যাতে অনেক পাঠক ও দর্শক এটিতে আসেন ও ওয়েবসাইট-টিকে সমৃদ্ধ করেন।
২০২০-র এই সপ্তাহটি বাংলা শিল্প জগতে এক অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়। জার্মানিতে আমরা হারালাম আলোকরঞ্জনী যৌবনবাউলের কবি শ্রী অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তকে। উদ্দালক (ভরদ্বাজ ) শ্রী অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তকে শ্রদ্ধা জানিয়ে একটি মনোজ্ঞ প্রবন্ধ পাঠ করল, যার শুরু কবিরই কবিতায়, “আমাকে আমি ভুলেছি এই একুশে আশ্বিনে” এবং এর সঙ্গে কবির নিজের লেখা থেকে আরো বেশ কয়েকটি কবিতা। অলোকরঞ্জন-এর সুললিত ভাষা, শব্দ চয়ন এক নিজস্ব সরণী তৈরী করেছে বাংলা সাহিত্যে। রিখিয়ার ছেলেবেলার দিনগুলি তারপর মায়ের হাত ধরে শান্তিনিকেতনে আসা ও থাকা সেই শিশুমনে গড়ে তুলেছিল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তাঁর নিবিড় সখ্যতা ও প্রেম। আজীবনকাল সমকালীন কবিদের থেকেও তাঁর স্বাতন্ত্র বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য এই অর্থে। পঞ্চাশের দশকের এই কবি এক দিকে যেমন সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ও জীবনানন্দ -এর কবিতায় বেড়ে উঠছেন আবার বিদেশী কবিদের সঙ্গে তাঁর নিত্য আসাযাওয়া, আবার আধুনিক বাংলা কবিদেরও তিনি এক অনন্য ও অমোঘ যোগসূত্র। উদ্দালক এইরকম অনেক তুলনা তুলে আনলেন অংশুমান কর ও বিভিন্ন আরো সমমনস্ক কবির সাহিত্যিকের লেখা থেকে। অলোকরঞ্জন-এর ‘নির্জন দিনপঞ্জী’ কাব্যগ্রন্থ থেকে কিছু কবিতাও শোনা গেল। শ্রী রজতকান্তির (সিংহ চৌধুরী ) র ভাষ্য থেকে সুপর্ণা সেন রহস্য উন্মোচিত হল। নীচে পূর্ণ লেখাটিটি দেওয়া হল উৎসাহী পাঠকের জন্য ***।
শ্যামলী (মিত্র) শ্রীজাতর লেখা থেকে দুটি সুন্দর কবিতা /লেখা পাঠ করল শ্রী অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তকে নিয়ে, ‘সময় নাও’ কবির প্রতি অনুজ কবির আর্জি ।
সুমিতা (বসু ) নিজের সুদীর্ঘ পরিচয় ও স্নেহধন্য অভিজ্ঞতার কথা বড় শোকস্তব্ধ হৃদয়ে ভাগ করে নিল সকলের সঙ্গে, কবির কথ্য ভাষাও যে ছিল মুক্তোখচিত, যেমন , মূল্যবোধের সম্মান ত্যাগ করো না কোনোদিন, ওরা আছে মুক্ত কারাগারে , সরবে চিন্তা করো সমাধান থাকবেই, হতাশার আরেক নাম হেরে যাওয়া !
পরবর্তী শ্রদ্ধা জ্ঞাপন শ্রী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে। নীতা শুরু করল প্রথমে।
বাঙালি হিসেবে তাঁর চতুষ্কোন প্রতিভা বৈদুর্য মণির মতো জ্বাজল্যমান। সিনেমার নায়ক বলে তাঁকে আমরা সহজেই চিনি, সত্যজিৎ রায়ের ৪৪ টি সিনেমার মধ্যে ১৪টিতেই ছিলেন সৌমিত্র, কিন্তু ফিল্মস্টার ছাড়াও নাট্যকার, পরিচালক, অভিনেতা, অনুবাদক, কবি, আবৃত্তিকার –এক কথায় কী করে ধরবো টিনাকে এতো স্বল্প পরিসরে ? সাংস্কৃতিক জেনেটিক কোডে ছিল দুর্দমনীয় প্রতিভা, যার এক কথায় নাম সৌমিত্র। নীতা সৌমিত্রের নিজের লেখা ‘রুমাল’ কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনালো, যেখানে হারানো অপরিচ্ছন্ন রুমালে শুধু চোখের জল। এছাড়া শোনা গেল সৌমিত্রর কথা গীতাঞ্জলির একটি কবিতা।
প্রসঙ্গত শ্রাবণীও (রায় আকিলা) সৌমিত্র কবিতাপাঠ সংক্রান্ত তার এক সুন্দর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলল সকলকে, যেখানে সাধারণ দর্শক তাদের কোলাহলে নায়ক সৌমিত্রকে খুঁজতে গিয়ে কবি ও কবিতার সৌমিত্রকে অবহেলা করছেন। শান্ত হয়ে গেল জনমন্ডলী এই কথা শুনে !
শ্যামলী ও বিশ্বরুচি (মিত্র) এক সুন্দর আলেখ্য পরিবেশনা করল সৌমিত্রের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনে।
হিউস্টনের সকলের প্রিয় ও সংস্কৃতিমনা সুনন্দনদাকেও সদ্য হারিয়েছি আমরা। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় ও ভালোবাসায় কমলপ্রিয়া (রায়) স্মৃতিচারণ করল তাঁর উদ্দেশ্যে।
ভজেন (বর্মন ) পড়লেন মৃত্যু বিষয়ক তাঁর মর্মস্পর্শী কবিতা, ‘অনিশ্চয়তা ‘।
অতিথি গৌরীদি (ডঃ গৌরী দত্ত / বস্টন ) এই সভায় ছিলেন আমন্ত্রিত এবং স্বরচিত দুটি কবিতা পাঠ করে শোনালেন, ব্রেস্ট ক্যান্সার ও আগন্তুক। খুবই ঘন কালো এই বিষয় নিয়ে গৌরীদির কলমে ও শব্দের জাদুবন্ধে সাহিত্যরূপ পেয়েছে কবিতাগুলি।
আমাদের সকলের বরেণ্য অসিতদার (সেন) লেখা থেকে জানা গেল ১৮৯৬ থেকে ২০২০ পর্যন্ত এই সুদীর্ঘ বছর ফরাসী সংস্থা ৩৮ জন ভারতীয়কে সম্মান জানিয়েছেন, যার মধ্যে ছিলেন সত্যজিৎ রায় ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। অসিতদার প্রস্তাব, আমরা যেন এই লেখা পড়ে ও সম্মান প্রদর্শন করেই থেমে না যাই, কোনোভাবে শিল্প ও শিল্পীর কল্যাণার্থে সম্মিলিত ভাবে অর্থসংগ্রহ করে কিছু করা যায় কিনা, এই ভাবনারও শুরু হোক এখানে।
অতিথি সুমিত (নাগ / বস্টন ) পড়ে শোনালেন তথ্য সমৃদ্ধ প্রবন্ধ, “মোদের গরব “ –বাংলা ভাষা ও শব্দের উচ্চারণ নিয়ে আলোচনা, যার মধ্যে নিয়ম ও ব্যতিক্রম পঠিত, আলোচিত ও বিতর্কিত আলোচনা মাতিয়ে রাখলো সভাকে। শেষের কবিতার নায়ক “অমিতের” না হয়ে রবীন্দ্রনাথ কেন “অমিতর” লিখেছিলেন, এই নিয়ে সভার মধ্যে কথোপকথন চলল অনেকক্ষণ।
সুমিতা (বসু) পাঠ করল স্বরচিত ভারতীয় ও বাঙালীর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উপনিবেশ নিয়ে এক মননশীল ও তথ্যপূর্ণ প্রবন্ধ–
“আমরা শুরু করছি ১৮০০ শতকের মাঝখান থেকে, সে সময় ব্রিটিশাধীন ভাতরবর্ষে বাংলার নবজাগরণ কলকাতার বুকে। কলকাতা ভারতের রাজধানী, বাংলা অবিভক্ত, পুব আর পশ্চিম এই লেখাতে সেই বাংলা থেকেই যে প্রথম প্রবাস-এ পদার্পন হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, তাদেরই কথা । বাস্তু-উদ্বাস্তু- অনাবাসী -অভিবাসী ও প্রবাসী প্রত্যেকটি শব্দই একে অপরের সঙ্গে যুক্ত আবার বিযুক্ত। এখানেই শুরু হয় আমাদের শিকড়ের সন্ধান।
প্রথম যে সব বাঙালীরা এসেছিল, তারা প্রায় বেশির ভাগই পুব বাংলার থেকে, প্রধানত জাহাজের খালাসী। ১৯৪৮ সালে হারলেম-এ ইব্রাহিম চৌধুরীর উদ্যোগে প্রথম যে বাঙালী রেস্টুরেন্টটা হয়েছিল, তার নাম বেঙ্গল গার্ডেন। এভাবেই বাঙালীরা হার্লেমে নিজেদের একটা আস্তানা গড়ে তুলল।”
সর্বশেষে শ্রাবণী (রায় আকিলা) রুট ৬৬ ও এই উদ্যাগ নিয়ে এক বিশদ ও বিশেষ অসহ্প্রদ বক্তব্য রাখল, যেখানে হাইওয়ে ৫ থেকে ৯৫ ও ১০ থেকে ৯০ এসে মিলবে বাংলা সাহিত্যের ঝুড়ি নিয়ে এই রুট ৬৬এ।
সভাভঙ্গ হল একটু দেরিতেই, আলাপ আলোচনা ও পাঠে ব্যস্ত প্রবাসবন্ধুর চোখকে ফাঁকি দিয়ে ঘড়ির কাঁটা তখন মিটমিট করে হাসছে, সন্ধ্যে ৭ টা !
সভান্তে ভার্চুয়াল গৃহস্থের কল্যাণ জানিয়ে , সঞ্চালিকার প্রতি সাধুবাদ ও অতিথিদের নমস্কার জানিয়ে একে একে বিদায় নিলেন বাকি সদস্যবৃন্দ।
আগামী সভায় আবার হবে দেখা ডিসেম্বর এ।
————————————————-
***সুপর্ণা সেন কে?
সুপর্ণা সেন! বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক মোহন প্রহেলিকা।
শঙ্খ ঘোষ এবং অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত তখন বিশ্বকবিতার বাংলা অনুবাদের সেই মহাগ্রন্থ ‘সপ্তসিন্ধু দশদিগন্ত’ নির্মাণ করছিলেন, যে-মণিমঞ্জুষার মধ্যে শঙ্খ-অনূদিত এলিয়টের ‘The Dry Salvages’, আলোক সরকার-অনূদিত শিলারের ‘Zu Fruhling’ (বসন্তের প্রতি) -সহ বিশ্বকবিতার বহু মণিমুক্তো ছিল, ছিলেন অনুবাদক রবীন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রিয়ংবদা দেবী, অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, মোহিতলাল মজুমদার, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, দিনেশ দাস, নরেশ গুহ, জ্যোতির্ময় দত্ত, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, দীপংকর দাশগুপ্ত, দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, অরুণ মিত্র, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সুনীল বসু, কবিতা সিংহ, মানস রায়চৌধুরী,লোকনাথ ভট্টাচার্য, পূর্ণেন্দু পত্রী, বিনয় মজুমদার, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু প্রমুখ এবং স্বয়ং অলোকরঞ্জন, যাঁর কাছে অনুবাদ নিজেকে আবিষ্কার করবার এক বিনীত উপায়, যাঁর অনুবাদে কোলরিজের ‘বুড়ো নাবিকের উপকথা’ (The Rime of the Ancient Mariner) তো বটেই, ছিল কীটসের নয়, হ্যোল্ডারলিনের ‘হাইপেরিয়ন’-সমেত নানান মেজাজমর্জির অগণন বৈচিত্রের সব পুষ্পাসব।
এরপর আমরা শঙ্খ ঘোষের অনুপম বয়ানে চলে যাই, ‘সপ্তসিন্ধু দশদিগন্তে’র জন্মলগ্নে?
শঙ্খ লিখছেন : “কোনো কবির অনুবাদ পাওয়া যাচ্ছে না তবু? কোনো সমস্যা নেই, অলোকই ঝটপট করে দেবে সে-কাজ। কিন্তু অনেক লেখা কি হয়ে যাবে না ওর একারই নামে তবে? ঠিক আছে, তাহলে একটা ছদ্মনামের উদ্ভাবন করা যাক। সপ্তসিন্ধুর লহরে লহরে জেগে উঠলেন এক নতুন কবি ‘সুপর্ণা সেন’।”
এখানে এক ব্যক্তিগত স্মৃতি ভাগ করে নেওয়ার লোভ সংবরণ করা উচিত হবে না। ‘সপ্তসিন্ধু দশদিগন্ত’ পড়তে পড়তে এই তথাকথিত সুপর্ণা সেনের অনুবাদে এক কবিতায় পেয়ে গেলাম, ‘সুচির জলধারা ছায়ায় গান করে / নতুন ফুলগুলি শোনে।/ এখানে কাউকেই আসতে দিয়ো না/
নগ্ন রমণীকে ছাড়া।’ ( মূল কবিতা হিমেনেথের।)
বলে ফেললাম, অলোকদা, এ কোনো মহিলা কবি লিখবেন না বা অনুবাদ করতেও অনুপ্রাণনা পাবেন না!
সহাস্য অলোকরঞ্জনের জবাব, “এইখানে ‘সুপর্ণা সেন’ বমাল-সমেত ধরা পড়েছেন একেবারে!”