ফেব্রুয়ারী ২৩, ২০২০ – উদ্দালক ভরদ্বাজের লেখনীতে সভা বিবরণী প্লাস……
বসন্ত, পরাগরেণু ও শূন্যসূচী
দেখা যাচ্ছে খুব বেশী প্ল্যান না করাই ভালো। এবারের বসন্ত (এবং অ্যালার্জি উদ্রেককারী পরাগ রেণুর)-সমাগম সমাবেশের কয়েক ঘণ্টা আগেও লিস্ট প্রায় ফাঁকা। আমি একটি পাঁচ মিনিটের অনুবাদ কবিতা পাঠ জুড়েছিলুম। রবিদা টেক্সট করে বললেন আর কিছু পড়বে নাকি? আমি বললুম হ্যাঁ, সঙ্গে ল্যাপটপ থাকলে পড়তে কোন অসুবিধা কই? কিন্তু শেষমেশ দেখা গেল সময় হল না সেই কবিতা পড়ার। কারণ ততক্ষণে লিস্ট ভরে গেছে। মনও ভরে গেল আমাদের সকলের। দু ঘণ্টা সময় কোথা দিয়ে উড়ে গেল জানি না।
১৮৬৫ সালে প্রকাশিত লুই ক্যারলের লেখা আলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড এর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা, প্রাসঙ্গিকতা, এবং ছোট বড় সকলের কাছে এর আবেদনের উত্তরোত্তর বৃদ্ধি এবং ফলস্বরূপ এই বইয়ের নতুন নতুন মূল্যায়নের প্রয়োজন নিয়ে, ২০১৫ সালে আলিসের ১৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে লেখা, শিশির রায়ের রচনা “খুকির দেড়শো কাণ্ড”র প্রসঙ্গে, রবিদা, নিজের লেখা রূপরেখাটি পাঠ করলেন। জানতে পারলাম অনেক অজানা তথ্য, আভাস পেলাম, আপাত-শিশুপাঠ্য আলিসের ছত্রে ছত্রে আসলে লুকিয়ে রয়েছে বিজ্ঞানী চার্লস লুটউইজ ডজসন (লুই ক্যারলের আসল নাম) এর নানান দার্শনিক এবং বৈজ্ঞানিক মতবাদ। জানলাম, কি করে ১৮৬২-র ৪ জুলাই এক বিকেলে, একটা নৌকোয় বসে, তিনটে বাচ্চা মেয়ের মন রাখতে, একটা গল্প বলতে গিয়ে অবরতারনা হয়েছিল বিশ্ব-শিশুসাহিত্যের এক উজ্জ্বলতম সৃষ্টির। জানলাম, কি করে ‘চার্লস’ এর শেকড় আসলে ল্যাটিন ‘ক্যারোলুস’-এ, সেখান থেকে নিলেন ছদ্মনামের ‘ক্যারল’। আর তেমনই ল্যাটিন ‘লুডোভিগোস’ থেকে ‘লুটউইজ’ ছুঁয়ে ‘লুইস’! আর তারপর গল্পের উদ্ভুট্টি মেজাজের সঙ্গে জম্পেশ তাল ঠুকে যেন, ক্যারল লুইস একটা ডিগবাজি খেয়ে হয়ে উঠলেন লুইস ক্যারল!
‘আ সিলেবাস অব প্লেন অ্যালজেব্রাইক জিয়োমেট্রি’র লেখক, লিনিয়ার এবং ম্যাট্রিক্স অ্যালজেব্রা, ম্যাথামেটিকাল এবং সিম্বলিক লজিক নিয়ে যাঁর গুরুভার রিসার্চ, তিনিই ছিলেন আলিসের রচয়িতা। বিজ্ঞান আর ফ্যান্টাসিকে সমান আদরে লালন করে, খেয়াল-রসকে পাখা মেলতে দিয়েছিলেন গাণিতিক সূত্র আর লিটারারি ননসেন্স-এর বিস্তারে। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় ছোটবেলা থেকে শোনা একটি গল্পের। ইংল্যান্ডের রানী যখন আলিস পড়ে শেষ করলেন তিনি নাকি আদেশ করেছিলেন “এই লেখকের পরের বই ছাপা হওয়া মাত্রই যেন আমার টেবিলে চলে আসে”। এবং কি করে কয়েক মাস পড়ে এলিজাবেথের টেবিলে স্থান নেয় ডজসনের সদ্য-ছাপা গণিত বইয়ের। এই গল্পের আকর্ষণীয়তা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল এতই প্রবল যে শেষ পর্যন্ত ডজসন নিজেই তাঁর এক বইয়ের ভূমিকায় উল্লেখ করতে বাধ্য হন যে এরকম ঘটনা কখনোই ঘটেনি। আদ্যোপান্ত ব্যাপারটি নিছকই এক গালগল্প মাত্র।
রবিদার লেখায় নানান প্রসঙ্গের অবতারণার মধ্যে একটি নজর কাড়ল, তা হল সময়ের ধারণা সম্পর্কিত। ওয়ান্ডারল্যান্ডে অ্যালিসকে এক বার ছোট্ট এক বার বড় হতে হয়। ক্রমাগত ছোটবড় হওয়ার খেলায় ক্লান্ত অ্যালিসকে যখন শুঁয়োপোকা জিজ্ঞেস করে ‘তুমি কে?’, অ্যালিস বলে, ‘আমি যে আসলে কে, বলা খুব কঠিন। আজ সকালে যখন ঘুম থেকে উঠেছিলাম, তখনও জানতাম আমি কে, কিন্তু তার পর থেকে এত বার বদলেছি যে…’ পড়ে মনে হয়, সত্যি তো, সারা দিনে এই আমিই কত বার বদলে যাই! অনর্থক অপমানে ছোট হই, অযাচিত ভালবাসায় বড়। দিনভর কষ্টভয়লজ্জাঘেন্নাওয়ালা এত লক্ষ ছোটবড় আমির কোনটা আসল আমি, কী করে বলি? কখনও অ্যালিসের ঠোঁটে ক্যারল বলেন, ‘আই কান্ট গো ব্যাক টু ইয়েস্টারডে বিকজ আই ওয়াজ আ ডিফারেন্ট পার্সন দেন।’ ক্যারল তো নয়, যেন বহু যুগের ও-পার হতে বলে ওঠেন হেরাক্লিটাস: এক নদীর জলে তুমি দু’বার পা ভেজাতে পারো না, কারণ নদীটা তো আর কালকের নদী নেই, আর তুমিই কি ভাই কালকের তুমি আছ? ‘সময়’ নিয়ে কী যে সব দামি কথা বলে গেছেন ক্যারল, তাঁর অনবদ্য হেঁয়ালি-ভাষায়! পাগল হ্যাটার অ্যালিসকে বলে, সময়কে একটু জপাতে হয়, বুঝলে? তা হলে দেখবে তাকে নিয়ে তুমি যা-খুশি-তাই করতে পারো। ধরো, সকাল ন’টা বাজে, পড়তে বসতে হবে। তুমি স্রেফ সময়ের কানে কানে একটু বলে দিলে, আর সে-ও পাঁইপাঁই করে ঘুরে নিমেষে দেড়টা বাজিয়ে দেবে, লাঞ্চ টাইম! অ্যালিস বলে, কিন্তু তখন যদি খিদে না পায়? হ্যাটার বলে, আরে বাবা, সময় তখন দেড়টার ঘরে ঠায় থেমেই থাকবে, তোমার খিদে পাওয়া ইস্তক! সাদা খরগোশকে অ্যালিস জিজ্ঞেস করে, হাউ লং ইজ ফরএভার? উত্তর আসে, সামটাইম্স, জাস্ট ওয়ান সেকেন্ড। এমন কথাকেই বোধহয় ‘আর্ষ’ বলে!
এই প্রসঙ্গের হাত ধরে, উদ্দালক পড়লেন পোলিশ কবি উইস্লাওয়া সিম্বরস্কার তিনটে অদ্ভুত শব্দ (The Three Oddest Words) এর অনুবাদ। সেই কবিতায়ও আমরা দেখি সময়ের একটি সমার্থক ধারণার কথা। যেখানে কবি বলছেন
“ভবিষ্যৎ”
কথাটা উচ্চারণের শুরুতেই তো
প্রথম অংশ অতীত হয়ে যায় !
“নিঃশব্দ”…
বললেই খান খান হয়
নিস্তব্ধ প্রহর,
খুন হয় শান্তির সময় ।
“কিছু না” বলি যখন আমি,
কিছু যেন তৈরি হয়ে যায়,
কায়িক…নিশ্চল…স্থির
ছুঁয়ে ফেলা যায় ।
আর্ষ শব্দ যে ঋষি-উক্ত এই প্রসঙ্গে শুরু হল ভাষা নিয়ে নানা আলোচনা, যা এই সভায় একটি নতুন সম্ভাব্য প্রজেক্টের প্রসঙ্গে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। কিন্তু সে কথা পরে। রবির পর, উদ্দালক পড়লেন ১৯৮৪ সালে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত চেক কবি জারোস্লাভ সিফার্টের দুটি কবিতার বাংলা অনুবাদ। ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত সিফার্টের কবিতার ইংরেজি অনুবাদের সঙ্কলন An Umbrella from Picadillyর সমালোচনা করতে গিয়ে মাইকেল হেনরি লিখছেন “এক অভূতপূর্ব সৃষ্টিশীল জীবনের পড়ন্ত বিকেলের আভা এই কবিতাগুলির শরীরে ছড়ানো। এক নিঃশর্ত আনুগত্য, অন্তরঙ্গ ভাষার প্রতি, নারীর প্রতি (এবং এই অনুরাগ নারীকে শুধু এক সর্বাঙ্গ সুন্দর সৃষ্টি রূপে নয়, সমগ্র মানবতার প্রতীক হিসেবে দেখায়) এই কবির কবিতার প্রত্যেক ছত্রে ছড়ানো”। ‘কবির জীবন’ কবিতায় কবি তাঁর কবিতা ও জীবনের এই সারমর্মের কথাই তুলে ধরেন। কবিতার ভাষা যেন ছবি এঁকে দেয় পাঠকের মনে, কবিমনের, কবিজীবনের। ‘পিকাডেলির ছাতা’ কবিতায় কবি রসিক প্রেমিক। বয়েসের ভারে ন্যুব্জ কবি, কিন্তু সৌন্দর্য এখনো হাতছানি দিয়ে যায় তাকে। তবু সেই রূপের কাছে গিয়ে সেই অনুরাগ ব্যক্ত করার সময় বা সুযোগ এখন আর নেই। তাই সেই ইচ্ছাকে এড়িয়ে যেতে কবি বৃষ্টি এবং ছাতার অনুষঙ্গে এক অদ্ভুত কমেডির সৃষ্টি করেন যা একই সঙ্গে মনে এনে দেয় বেদনা এবং সহজ সরল হাসির উচ্ছাসও।
ভাষা দিবসের উপলক্ষে মৃণাল চৌধুরী তাঁর নিজের লেখা এবং স্মৃতি থেকেই আলোচনা করলেন বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের প্রথম (এবং সেই প্রথম লগ্নে, একক) সৈনিক শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের কথা। ১৯৪৮ সালে ধীরেন্দ্রলাল দত্ত যখন পাকিস্তানের গণপরিষদে উর্দুর সঙ্গে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী তোলেন, তখন তাঁর পাশে কেউ ছিল না অথচ চার বছরের মধ্যে ১৯৫২ সালেই সেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে আগুনের মত। অথচ সেই সভায় তাঁর বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে শুনতে হয়েছিল লিয়াকত আলী খানের তির্যক কটূক্তি যে তিনি হিন্দু ভারতের দালালি করছেন। আজকের সভা বিবরণীতে হয়ত এই অংশটুকু একটি অংশের মত করেই লেখার ছিল। কিন্তু মনে হল, বাংলা ভাষার এই পরম সাহসী সৈনিকের বীরত্ব, চেতনা এবং বলিদানের কথা, আমাদের সকলের জীবনে, এই সাহিত্যসভার জীবনে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, তাই সয়েদ বদরুল আহসান মশায়ের ১৯১৬ সালে লেখা একটি ইংরেজি রচনার থেকে ধার করে কিছু কথা নিচে লিখলাম।
বাংলার ,মানুষের স্বপ্নের রূপকার উনি। সেই স্বপ্নের উড়ান জারি রাখতে অবশ্য নিজেকে বলি দিতে হয়েছিল তাঁকে। অথচ তাঁর মৃত্যু এঁকে দিয়েছিল হাজার তারা বাংলার আকাশে। আমাদের নীরব শ্রদ্ধায় আমরা স্মরণ করি তাঁকে। স্মরণ করি কারণ তিনি ছিলেন আমাদেরও ততটাই যতটা আমরা ছিলাম তাঁর। তাঁর মধ্যে একজন আদর্শ এবং ধীমান মানুষ এবং নেতৃত্বের সব গুণ ছিল। অনেক আগেই উনি সঠিক বাস্তব অনুধাবন করেছিলেন বলেই আজকে আমরা পেয়েছি আমাদের সঠিক উত্তরাধিকার। যে ভাষা আন্দোলন আজ আমরা উদযাপন করি আসলে তা আমদের সম্মিলিত চেতনায় ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত মশাইয়ের নীরব অবস্থিতিটুকুই। কারণ উনিই প্রথম পাকিস্তানের সঙ্গে রাজনৈতিক অবস্থিতির বিপাকের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও, আমাদের বাঙালি ঐতিহ্যকে ভালবাসতে শিখিয়েছিলেন।
১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের গণপরিষদের সভায়, যখন উনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন যে পাকিস্তানের রাজনৈতিক এবং সাংবিধানিক ভবিষ্যতে বাংলার একটি জায়গা থাকা একান্ত রূপে আবশ্যিক, আসলে উনি আমাদেরই মনে করাতে চাইছিলেন, যে নিযুত শতাব্দীর সংগ্রাম এবং অধ্যবসায়ে যে সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধ গড়ে উঠেছে, তাকে সাম্প্রদায়িকতার হাঁড়িকাঠে বলি দেওয়া যায় না, যাবে না।
তাঁর মাতৃভাষাকে তার যোগ্য আসনে অধিষ্ঠিত করার আয়োজনে তাঁর নিজের ভাষা ছিল প্রাঞ্জল, স্পষ্ট এবং তীক্ষ্ণ। উনি বলেছিলেন-
“I know, Sir, that Bengali is a provincial language, but, so far as our state is concerned, it is the language of the majority of the people of the state. So although it is a provincial language… it is a language of the majority of the people of the state and it stands on a different footing therefore. Out of six crores and ninety lakhs of people inhabiting this state, four crores and forty lakhs of people speak the Bengali language. So, Sir, what should be the language of the state? The language of the state should be the language which is used by the majority of the people of the state, and for that, Sir, I consider that the Bengali language is a lingua franca of our state.”
সেদিন সেই সভায় দ্বিতীয় কোন কণ্ঠ ধীরেন্দ্রনাথের সঙ্গে ছিল না। অথচ তার এই একক, নিশ্চিত, নির্ভীক শব্দের স্ফুলিঙ্গই তদানীন্তন পাকিস্তানের সমস্ত বাঙালির সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষাকে রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিল। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস ছিল সেই সমর্থনের দিন। মাত্র চার বছর আগে তাঁর কণ্ঠ ছিল নিঃসঙ্গ, একক অথচ সেদিন তাঁর স্বপ্নের সাথে সমগ্র দেশের মানুষ সামিল, তাদের পূর্বপুরুষের মাটির প্রতি এই অঙ্গীকারে। পাকিস্তানি সরকার যে তাঁর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে অপারগ হবে সে নিয়ে কিন্তু তাঁর কোন সংশয় ছিল না। ১৯৭০ সালের গোড়ার দিকেই উনি উনি কিন্তু বুঝতে পেরেছিলেন যে ওনার প্রাণসংশয় হতে পারে, লিখেও ছিলেন সে কথা তাঁর কলকাতা-বাসি পুত্র সঞ্জীব দত্তকে। কিন্তু আরও অনেকের মত, নির্ভীক ধীরেন্দ্রনাথ কিন্তু পূর্ব বাংলা ত্যাগ করতে অস্বীকার করেন। কারণ তিনি যে বাংলাকে ভালবসেছিলেন, সে বাংলা আজ রাজনৈতিক চালে পূর্ব বাংলা বলে অভিহিত হতে পারে কিন্তু সেই যে তাঁর জন্মদাত্রী, জন্মধাত্রী মা। ছেড়ে যেতে পারেন নি তাঁকে।
৪৭এর দেশবিভাগের পর, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়তে থাকা ধীরেন্দ্রনাথ, মনোনিবেশি হয়েছিলেন পূর্ব-পাকিস্তান নামের এক অসম্ভব রাষ্ট্রে গণতন্ত্রকে কায়েম করার কাজে। ১৯৫৪ সালের ক্ষণস্থায়ী যুক্ত ফ্রন্টের অংশ হিসেবে, আরও অনেক উদারমনা মানুষের মত উনিও বিশ্বাস করতেন যে বাঙালিদের মধ্যে অন্তত, রাজনীতি, ধর্মনিরপেক্ষ হয়েই ফিরে আসবে। দ্বি-জাতীয় মতবাদ তাঁর কাছে শুধু সাময়িক বিপথগামীতা ছিল না, ছিল অত্যন্ত বেদনাদায়ক এক বিভীষিকা। পাকিস্তান সরকার তাই তাকে জাতিশত্রু হিসেবে নির্ধারিত করে শেষ পর্যন্ত এই সর্বজনশ্রদ্ধেও, সার্বিক রূপে সুন্দর মানুষটিকে হত্যা করার পরিকল্পনা নেয় ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে। অপস্রিয়মাণ, লুণ্ঠনকারী পাক সেনাদের কাছে তখন একটিই লক্ষ্য, কি করে এই নব্য-জাগরিত বাংলাদেশকে ধ্বংস করে দেওয়া যায়, কি করে এই দেশের মাটিতে আবার পুঁতে দেওয়া যায় সঙ্কীর্ণ সাম্রদায়িকতার বীজ। যা কিছু বাঙালি, তাই তখন তাদের কাছে পাকিস্তানের অস্বীকৃতি স্বরূপ। এবং প্রত্যেক হিন্দু পাকিস্তানের গদ্দার। আর তাই, মধ্য যুগীয়, বর্বর, নির্লজ্জ দখলকারী পাকসেনা, রাতের অন্ধকারে এই ৮৫ বৎসর বয়েসী মানুষটিকে এবং তাঁর এক সন্তান দিলিপ দত্তকে ধরে নিয়ে যায়। আর কোনদিন তাদের কোন খবর পাওয়া যায় নি।
নিঃস্বার্থ, সদাবিনয়ী, চিন্তাশীল, ধীমান, রাজনীতি-নিবেদিত অথচ উচ্চতম নীতির প্রতি সদা-অঙ্গীকারবদ্ধ এই মানুষটিকে তাই ইসলামীয় রাষ্ট্র পাকিস্তান দ্বারা হত্যার ৪৫ বছর পরেও স্মরণ করছি আমরা। কারণ ধীরন্দ্রনাথ তাঁর জীবন দিয়ে বুঝিয়ে গিয়েছেন মানুষের সমস্ত নীচতা, ক্রূরতা সত্ত্বেও আমাদের জীবন এক অতিন্দ্রিয় অনুভব, এক মহত্তর মহাজীবনের অংশ। এবং সে ভাবেও বাঁচা যায়, সমস্ত নীচতা এড়িয়ে।
বাংলাদেশ তাকে ভাবাত, বাংলার মানুষ তাকে ভাবাত, অনুপ্রেরণা দিত। বিশ্বাসের এই প্রস্তরখণ্ডে ভর করে জীবন অতিবাহিত করেছিলেন বলেই আজ তাঁর বিশ্বাস সমগ্র দেশের চেতনায় ছড়িয়ে গিয়ে আমাদের শক্তি জুগিয়েছে যাতে আমরা আমদের ভবিতব্যের ভার আমরা নিজেরাই নিতে পারি। শক্তি দিয়েছে, যাতে ইতিহাসের এক মুহূর্তকে করায়ত্ত করে তাকে আমরা আমদের স্বপ্নের রূপ দিতে পারি। যে স্বপ্নের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের মহানুভবতা এবং বিশালতা। ধীরেন্দ্রনাথ আমাদের একটা স্বপ্ন দিয়ে গেছেন, পাহাড়ের মাথায় একটা শহর বানানোর, গৌরবে উজ্জ্বল, কাব্যময়তায় অধীর, ভালবাসায় উদ্বেল।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্তঃ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে নিরলস সংগ্রামকারী, রাজনৈতিক নেতা, বিদ্বান মনীষী, বাঙালি সার্বভৌম রাষ্ট্রবাদী; জন্ম ২রা নভেম্বর, ১৮৮৬, রামরেল, ব্রাহ্মণ বাড়িয়া, কুমিল্লা, অধুনা বাংলাদেশ; নিখোঁজঃ ২৯শে মার্চ, ১৯৭১, কুমিল্লা
কবি শফিক আহমেদ পড়লেন তাঁর সাম্প্রতিক কালে লেখা কবিতা দেজা ভু/ফিরে দেখা”। সাধারণত কবির লেখায় আমরা প্রেমের নানা রূপের কথাই শুনে থাকি, আজ এই ব্যতিক্রমী কবিতায় এক নতুন স্বাদ পেলাম আমরা। প্রথম লাইনেই পাঠক ধরে ফেলে এই কবিতার উচ্চারণ তাঁর অন্যান্য কবিতার চেয়ে আলাদা, যখন কবি লেখেন
আমি আজকাল আমাকে নিয়ে খুব চিন্তিত
দৈনন্দিন জীবনে যাই ঘটছে,
মনে হয়ে আগে কখনো ঘটেছে।
বর্ণ, গন্ধ, স্পর্শ, দৃশ্য
সব কিছুতেই মিল পাচ্ছি
ঘটে যাওয়া জীবন স্মৃতির,
আমি আজকাল কিছুই ভুলছিনা।
যেন আজকের সভার সময়ের ধারণার সাথে তাল মিলিয়েই দেখি কবির কবিতাতেও এক সময়ের সাথে এক অন্য সময়ের মিশে যাওয়ার প্রবণতা, হয়ত ইচ্ছাও। হিউস্টনের ট্রেনের আওয়াজে যখন কলকাতার ট্রামের ঘণ্টা শোনা যায়, মেমোরিয়াল পার্ক এ শীত শীত সকালের কুয়াশা ছিঁড়ে আসা সূর্য মনে করিয়ে দেয় ভোরবেলা উঠে ইডেন গার্ডেনসে টেস্ট ম্যাচ দেখতে যাওয়ার স্মৃতি, ভূমধ্য সাগরে বিলাসবহুল প্রমোদতরী কবিকে মনে করিয়ে দেয় ছেলেবেলার ইচ্ছামতীর ভরা কোটালে ভাসতে থাকা ডিঙ্গি নৌকা, কবির মত, আমাদেরও মনে হয়, আমরাও যেন
…স্মৃতি বিস্মৃতির দোলাচলে
পেন্ডুলামের মতো দুলে চলেছি
ভূত ভবিষ্যৎ আর বর্তমানের মধ্যে।
কবির অন্য এক সৃষ্টি বিবিজানের আবহসঙ্গীত-সহ আবৃত্তি কবি আবার শোনালেন আমাদের, তাঁর ব্লু-টুথ স্পিকারে। আবারও ভালো লাগল সবার। একটি সাধারণ মেয়ের কোঠাবাড়ির বিবিজান হয়ে ওঠার কঠিন ও করুণ বৃত্তান্ত প্রতিবারের মত এবারেও ভাবাল আমাদের।
ভজেন্দ্র বর্মণ তাঁর নিজের লেখা থেকেই পরিসংখ্যান দিয়ে ব্যক্ত করলেন আজকের দিনে বাংলাভাষার ব্যপ্তি ও গুরুত্বের কথা। ২০১৫ সালের হিসেব অনুযায়ী সারা পৃথিবীতে ছিল প্রায় ২৮০ মিলিয়ন (২৮ কোটি) বাঙালি। পৃথিবীর প্রায় ৯০০০ ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষার স্থান ছিল ৯ম। চর্যাপদের রচনা সাল নিয়ে বিতর্কের অবতারণা হল যেহেতু ভজেনদার লেখায় বাংলা ভাষার রূপকরন হিসবে বিংশ শতাব্দীর আদিভাগকে চিহ্নিত করা হয়েছে। মূলত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রচেষ্টাকে লেখক বাংলা ভাষার মূল রূপকারী হিসেবে দেখিয়েছেন। আমার মনে হয় এ নিয়ে আমাদের আরও অনেক আলোচনা হওয়া দরকার এবং সময়ের নিরিখে কি ভাবে ধীরে ধীরে আমদের ভাষা গড়ে উঠেছে তা আমরা নিজেদের এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্যেও লিপিবদ্ধ করে যেতে পারি। হয়ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সব তথ্যই। আবার নতুন করে দেখে, একটু সাজিয়ে নিলে মন্দ কি? চর্যাপদ রচিত হয় আনুমানিক খ্রিষ্টীয় অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত, কি ভাবে ভাষা এগিয়েছে, in terms of milestones, যদি একটা timeline আমরা বানাতে পারি! পারি কি ?
ভাষা প্রসঙ্গে মৃণাল দা আর একটি কথা বললেন, সেও একটি প্রজেক্ট হতে পারে আমাদের সভার। এমন কিছু শব্দ যা কিনা একান্তই বাংলা। অর্থাৎ যার উদ্ভব বঙ্গদেশেই হয়েছে অর্থাৎ তৎসম নয়, এবং অন্যান্য ভাষা যেমন আরবি, ফারসি, ইংরেজি ইত্যাদি থেকে আসে নি। সেইরকম একটি শব্দের তালিকা কি আমরা বানাতে পারি ? যদিও এই ক্ষেত্রে আমার এখনো খুব স্পষ্ট ধারণা নেই যে এই শব্দগুলি কি তাহলে তদ্ভব শব্দদেরই একটি শাখা হবে। নাকি, মূলত আমরা অত্যন্ত সাম্প্রতিক কালে ঢুকে-পড়া কিছু শব্দের কথা বলছি এখানে। মৃণালদা উদাহরণ হিসেবে “আড্ডা” বললেন, কিন্তু দেখা গেল আড্ডা শব্দটির হয়ত অন্য উদ্ভব ইতিহাস থাকতে পারে, ভিন্ন অর্থও। একটি অন্য শব্দ মাথায় এলো, হৈচৈ। এই প্রসঙ্গে অর্থের আবহ প্রসঙ্গ এলো । তারেক ভাই বললেন এক একটি সমাজের আচার বিচার ব্যবহার অনুযায়ী একটি শব্দের অনুষঙ্গ গড়ে ওঠে। তাই কিছু শব্দের প্রতিশব্দ কখনো বাংলায় পাওয়া যায় না। আবার তেমনই কিছু বাংলা শব্দের প্রতিশব্দ হয়ত ভিন্ন ভাষা জানে না। এই বিষয়েও আমদের উচিৎ পৃথক আলোচনা ও গবেষণার জন্যে সময় দেওয়া। আমাদের সমস্ত সাহিত্য-ভাবনার নিরসন-কারি রবীন্দ্রনাথ অনেক সময় দিয়েছিলেন বাংলার শব্দকোশ সম্প্রসারণ এবং গঠনে, এ প্রসঙ্গে কিছু ইংরেজি শব্দের বঙ্গীকরনে তাঁর কাজের কথা পড়লেন উদ্দালক।
তারেক ভাইয়ের পড়া তাঁর স্বরচিত হাস্যরসাত্মক গল্পের আস্বাদে আমাদের গুরুগম্ভীর আলোচনার মেঘ সরে ফুটে উঠল অনাবিল হাসির আবহ। সরস ভঙ্গিমা তারেকের লেখায়। অনুভবে একাত্ম হতে পারলাম সবাই। চাইব তারেক এই ধরণের লেখা আমাদের প্রবাসবন্ধু পত্রিকাতে আরও ছাপুন। হাসির প্রয়োজন বড় বেশী এই প্রবাসী জীবন যুদ্ধে।
রূপছন্দা ঘোষ ভাষা দিবস উপলক্ষয়ে পড়লেন রুদ্র গোস্বামী রচিত “একুশ আগুন রঙের পাখি”। হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত রুদ্রর এই কবিতা মূর্ত হয়ে উঠল রূপছন্দার দৃপ্ত আবৃত্তির গুণে।
একুশ কি মা?
একুশ? একুশ একটা পাখির জন্মদিন।
পাখি!
ওর কি নাম? কি রঙ?
ওর নাম বাংলা ভাষা
আর ওর আগুন রঙ।
ও কোথায় থাকে?
তোমার, আমার,
আমাদের বুকের মধ্যে থাকে।
আমার বুকেও আছে?
আছে তো।
ইস ওর কষ্ট হয় না?
উড়তে ইচ্ছা হয় না?
ওড়ে তো।
এই যে আমি কথা বলছি
তোমার দিকে উড়ে যাচ্ছে।
তুমি কথা বলছ
আমার দিকে উড়ে আসছে।
কোথায়! দেখতে পাচ্ছি না তো?
এই যে তুমি নিঃশ্বাস নিচ্ছ,
নিঃশ্বাসকে দেখতে পাচ্ছ?
পাচ্ছি না তো!
ও কি নিঃশ্বাসের মতো মা?
এতক্ষণে ঠিক বুঝেছ।
ও বুকের মধ্যে কোথায় থাকে?
আমার বুকে কান পাতো।
কিছু শুনতে পাচ্ছ? পাচ্ছি তো,
টিক টিক টিক…
এই শব্দটাই
ওই পাখিটার বাসা।
পরে রূপ পড়লেন রবীন্দ্রনাথের “এমন দিনে তারে বলা যায়”। বসন্তের সমাগমে বর্ষার আবাহন হল প্রেমের অবতারণায়, এই চিরন্তন প্রেম গানে।
অবশেষে ডলিদির (ডলি ব্যানার্জী ) প্রযোজনায় সাহিত্য বিষয়ে কুইজ এবং তারপরে চন্দ্রাদির আয়োজনে বিশেষ ভুরিভোজ দিয়ে শেষ হল সভা। এ সভায় অনেক দিন পরে ইলাদি সুভাষদাকে দেখে খুব ভালো লাগল। সকলের জন্যে নিয়ে এসেছিলেন আঁখ এবং কলা, নিজেদের বাগান থেকে। সে হল উপরি লাভ।
পুনঃ- দেখা যাচ্ছে, নিয়ম আর সময়ের কঠিন ঘেরাটোপে বাঁধা পড়লে সভা তেমন স্বতঃস্ফূর্ত হতে পারে না। তাই, সভার স্বতঃস্ফূর্তির (স্বতঃস্ফূর্ততা কথাটাও খুব ভারী তার চেয়ে এটা বেশী ছিমছাম, ভুল হলেও) খাতিরে আমরা সবাই এবার থেকে দেরীতে সূচি ভরব, বা ভরব না। এই অর্বাচীন দাবী সহযোগে এবার ইতি টানি বৃত্তান্তের।
প্রবাস বন্ধু পাঠ চক্র ও বাংলা গ্রন্থাগার
বিষয়সূচী – ২৩শে ফেব্রুয়ারী ২০২০
সভা সঞ্চালনা: রবি দে
শুরু: ৩:৩০ বিকেল
বিষয় | উপস্থাপক | সময় | শুরু | শেষ | |
১ | অভিবাদন ও আসন গ্রহণ | দে দম্পতি / সকলে | ১০ মি. | ৩:৩০ | ৩:৪০ |
২ | কাজের কথা / আলোচনা , ইত্যাদি | কারোর কিছু বলার থাকলে | ৫ মি. | ৩:৪০ | ৩:৪৫ |
৩ | ওয়েবসাইট নিয়ে আলোচনা | সুমিতা বসু ও সহযোগিরা | ১০ মি. | ৩:৪৫ | ৩:৫৫ |
সাহিত্য চর্চা প্লাস ৪:০০থেকে ৬টা
বিষয় | উপস্থাপক | সময় | শুরু* | শেষ* | |
১ | রচনা পাঠ: খুকির দেড়শো কাণ্ড | রবি দে | ১৫ মি. | ৪:০০ | ৪:১৫ |
২ | “খুকির দেড়শো কাণ্ড” নিয়ে আলোচনা | সকলে | ৫ মি. | ৪:১৫ | ৪:২০ |
৩ | অনূদিত কবিতা পাঠ | উদ্দালক ভরদ্বাজ | ৫ মি. | ৪:২০ | ৪:২৫ |
৪ | স্বরচিত রচনা পাঠ ও আলোচনা | মৃণাল চৌধুরী | ১০ মি. | ৪:২৫ | ৪:৩৫ |
৫ | স্বরচিত রচনা পাঠ: Deja vu ও বিবিজান | সফিক আহমেদ | ১৫ মি. | ৪:৩৫ | ৪:৫০ |
৬ | স্বরচিত রচনা পাঠ ও আলোচনা | ভজেন্দ্র বর্মন | ১০ মি | ৪:৫০ | ৫:০০ |
৭ | কবিতা পাঠ | উদ্দালক ভরদ্বাজ | ৫ মি | ৫:০০ | ৫:০৫ |
৮ | স্বরচিত ইংরেজি গল্পের স্বঅনূদিত বাংলা পাঠ | আলী তারেক | ১০ মি | ৫:০৫ | ৫:১৫ |
৯ | আলোচনা | সকলে | ১০ মি | ৫:১৫ | ৫:২৫ |
১০ | গল্প /কবিতা / রচনা পাঠ | রূপছন্দা ঘোষ | ১০ মি. | ৫:২৫ | ৫:৩৫ |
১১ | কুইজ | ডলি ব্যানার্জী | ৫ মি | ৫:৩৫ | ৫:৪০ |
১২ | সভা শেষ / সময় থাকলে গল্প গুজব | সকলে |